দক্ষিণপন্থী রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত ইতিহাসকে মুছে ফেলে নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ইতিহাসের বানানো বয়ান তৈরি করার সবচেয়ে কাছের উদাহরণ ভারত। বিজেপি-আরএসএসের যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, সেটি টিকিয়ে রাখার প্রাণভোমরা হচ্ছে ‘ইতিহাসের মনগড়া বয়ান’। উদ্দেশ্য একটাই—জনস্মৃতি থেকে ইতিহাসের বহুমুখী স্রোতধারাকে মুছে ফেলে একটিমাত্র বয়ানের ওপর দাঁড় করানো। এমন একদল অনুগত-অনুসারী তৈরি করা, যাদের নির্দেশ দিলেই বুলডোজার কিংবা গানপাউডার নিয়ে অন্য ধর্মের, অন্য বর্ণের, অন্য মতের লোকদের বাড়িঘর, স্থাপনা ও মানুষদের গুঁড়িয়ে ও পুড়িয়ে দিতে ছুটবে।
ভারতে নিজেদের মতো করে ইতিহাসের বয়ান তৈরির জন্য দক্ষিণপন্থী বিজেপি দলের নেতৃত্ব, তাদের অনুসারী শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক, সিনেমা নির্মাতা, সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনফ্লুয়েন্সার, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি (হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার করে গুজব ও অপতথ্য ছড়ানো), ফেসবুকের বট বাহিনী (স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার বা ভুয়া অ্যাকাউন্টের একটি সংগঠিত নেটওয়ার্ক ) একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। ফলে তাজহলের নিচে তেজো মহালয় মন্দিরের দাবি থেকে শুরু করে কাশ্মীর ফাইলের মতো সিনেমা বানানো—কোনোটাই কাকতালীয় ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এর সবগুলোই সুসংগঠিত একটি মহাপরিকল্পনার অংশ।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামির ঐতিহাসিক সহযোগিতার সম্পর্ক নিয়ে দলটির বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্ব কৌশলী অবস্থানে থাকলেও বিভিন্ন স্তরের নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের ভাষ্যকে জনপরিসরে নিয়ে আসতে শুরু করেছেন। আগামী দিনগুলোতে এই প্রবণতা আরও বাড়বে বলেই মনে হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নিজেদের মনগড়া ইতিহাসের ভাষ্য তৈরিতে ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তি বিজেপির পথ ধরছে জামায়াতে ইসলামী।
এ বছরের বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে জামায়াতে ইসলামীকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজেদের মতো করে বয়ান তৈরির কৌশল দেখা গেল। এখানে উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার— ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে দলটির ঐতিহাসিক সহযোগিতা সম্পর্কে নতুন ভাষ্য দেওয়ার প্রচেষ্টা। এবার সেটি ঘটেছে সীমিত পরিসরে। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিরোধিতা, পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, ধর্মান্তরকরণ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য।
বুদ্বিজীবী হত্যাকাণ্ডে জামায়াত জড়িত থাকার বিষয়টি ১৯৭১ সালে ঢাকার মার্কিন কনসাল হার্বাট ডি স্পিভাকের গোপন তারবার্তা থেকেও জানা যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় স্পিভাক লিখেছেন, ‘নিহত বুদ্ধিজীবীরা সংখ্যায় কত তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে; কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, এটা “জামায়াতের থাগস”রা (দুর্বৃত্তরা) ঘটিয়েছে। এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয় যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর “কনাইভেন্স” বা সম্মতিতে এটা ঘটেছে। এ ঘটনা অবাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণতা এবং যুদ্ধাপরাধের দাবি তুলতে পারে। (মার্কিন দলিলপত্রের সাক্ষ্য: কেন বুদ্ধিজীবী হত্যা? কীভাবে জামায়াত জড়িত? মিজানুর রহমান খান; প্রতিচিন্তা, ৮ মে, ২০১৭)
লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাও ফরমান আলী ছাত্র-বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাও ফরমান আলী তাঁর হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার আশঙ্কা হলো, আগে যে নির্দেশটি দেওয়া হয়েছিল, সেটি বাতিল করার কোনো আদেশ হয়তো জারি করা হয়নি এবং কিছু লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আজও আমি জানি না, তাঁদের কোথায় রাখা হয়েছিল। সম্ভবত তাঁদের এমন কোনো এলাকায় আটক রাখা হয়েছিল, যার পাহারার দায়িত্বে ছিল মুজাহিদরা। আত্মসমর্পণের পর ঢাকা গ্যারিসনের কমান্ডার তাঁদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং তারা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কারণ, মুক্তিবাহিনী নির্মমভাবে মুজাহিদদের হত্যা করছিল। আটক ব্যক্তিদের হয়তো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বদনাম করার উদ্দেশে মুক্তিবাহিনী এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীও হত্যা করে থাকতে পারে। তখন ঢাকা ইতিমধ্যেই ভারতীয় বাহিনীর দখলে চলে গিয়েছিল। (হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী)
এবারে শহীদ বুদ্ধজীবী দিবসে জামায়াতের দু-একজন নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাও ফরমান আলীর এ বয়ানটি জনপরিসরে আনার প্রচেষ্টা দেখা গেল।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় বলেছেন, ‘যে সময় আমি (পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী) দেশ থেকে পালানোর জন্য চেষ্টা করছি, আমি জীবিত থাকব না মৃত থাকব, সে বিষয়ে কোনো ফয়সালা হয়নি; সে সময় পাকিস্তানি যোদ্ধারা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে, এটি আমি মনে করি রীতিমতো অবান্তর।’ (পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করবে, এটা অবান্তর: চবি সহ-উপাচার্য ১৪ ডিসেম্বর, প্রথম আলো)
দেশের বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন হাফিজ আশরাফুল হক বলেছেন, ‘এই বুদ্ধিজীবীরা খালি বুদ্ধি বিক্রি করে খায়। অমুক দল, তমুক দল, অমুকের অনুসারী; তাদের মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যাচার করে জাতিকে বিভ্রান্ত করে জাস্ট নিজের পকেটে টাকাপয়সা ঢোকায়। সেই বুদ্ধিজীবীরা হয়তো একাত্তরে সেই ১৪ ডিসেম্বর মরে নাই। এরা যারা মারছে, আপনারা আরেকবার একটু দেখেন; ডেফিনেটলি পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়া মেরেছে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।’ (বুদ্ধিজীবী দিবসের সভায় শিক্ষক বললেন, ‘ডেফিনেটলি পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়া মেরেছে’ ; ১৫ ডিসেম্বর প্রথম আলো)
বিজয় দিবসে যুব শোভাযাত্রায় চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম দাবি করেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে মুজিব বাহিনী এলাকায় এলাকায় গণহত্যা চালিয়েছিল। এই গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় ২৫ মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নামিয়ে ক্র্যাকডাউন করে দিয়েছিল।
অথচ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুজিব বাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক অস্তিত্বই ছিল না। এভাবে ইতিহাস বিকৃতির উদ্দেশ্য কী?
বিজয় দিবস উপলক্ষে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী আমির হামজা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ওই সময় যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল না, তারা ছিল ভারতের বিরুদ্ধে। এখন আমরা এটা জেনেছি। এত দিন আমাদের এই সত্য জানতে দেওয়া হয়নি।’
তবে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য অনেকটাই ভিন্ন ও কৌশলী। অক্টোবর মাসে নিউইয়র্কে একটি সমাবেশে দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেন, ‘সাতচল্লিশ থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের আজ ২২ অক্টোবর রাত ৮টা ১১ মিনিটে পর্যন্ত আমাদের দ্বারা যে যেখানে যত কষ্ট পেয়েছেন, আমরা বিনা শর্তে তাঁদের কাছে মাফ চাই। এটা গোটা জাতি হলেও চাই, ব্যক্তি হলেও চাই। কোনো অসুবিধা নাই।’
শফিকুর রহমান বলেন, ‘একাত্তরে জামায়াতের কোনো ভূমিকা ছিল না? অবশ্যই ছিল। জামায়াত তখন ফিল (বিবেচনা) করেছিল যে পাকিস্তান ইউনাইটেড (অখণ্ড) থাকা দরকার। তখনো কিন্তু পাকিস্তান; আওয়ামী লীগের বহু লিডার পাকিস্তান সরকারের আন্ডারে চাকরি করেছে। বেতন নিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের লিডার পরিবারের অনেকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রেশন নিয়েছে। বেনিফিট নিয়েছে।’ (বিনা শর্তে ক্ষমা চাইলেন জামায়াতের আমির, প্রথম আলো, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫)
জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, জনবুদ্ধিজীবী এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক রেহমান সোবহান প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তারা জোরালো নির্বাচনী সম্ভাবনাসহ আরও দৃশ্যমান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা এই সুযোগকে ব্যবহার করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের যে ঐতিহাসিক সহযোগিতার ভূমিকা, সেটিকে নতুন ভাষ্য দিতে চাইছে। রাজনৈতিকভাবে কৌশলী নেতাদের নেতৃত্বে তারা এই পর্যায়ে তাদের মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত অবস্থান কিছুটা সতর্কতার সঙ্গে প্রকাশ করবে। ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকা সাফসুতরো করার ক্ষেত্রে এটা তাদের একটা রাজনৈতিক কৌশল।’ (গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার সুযোগ নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫)
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামির ঐতিহাসিক সহযোগিতার সম্পর্ক নিয়ে দলটির বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্ব কৌশলী অবস্থানে থাকলেও বিভিন্ন স্তরের নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের ভাষ্যকে জনপরিসরে নিয়ে আসতে শুরু করেছেন। আগামী দিনগুলোতে এই প্রবণতা আরও বাড়বে বলেই মনে হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নিজেদের মনগড়া ইতিহাসের ভাষ্য তৈরিতে ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তি বিজেপির পথ ধরছে জামায়াতে ইসলামী।
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
*মতামত লেখকের নিজস্ব