মতামত

লন্ডন বৈঠক: কতটা বরফ গলল রাজনীতির

মনের মধ্যে অনেক কথা এখন। কোনটা বলি, ভাবতে ভাবতে মনে হলো, যা আগে আসে, তা–ই আগে বলি। পরে কী হয় দেখা যাবে। সেভাবেই শুরু করতে যাচ্ছি।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন সারা দেশে একটা স্বস্তির বাতাস বয়ে গিয়েছিল। কী বিরাট মাপের মানুষ! কোনো দিন রাজনীতি করেননি (তা না বলে বরং বলা উচিত, করতে গিয়েছিলেন, পারেননি। থুক্কু দিয়ে চলে এসেছিলেন। নিজে নিজে বুঝে নিয়েছিলেন, ওটি তাঁর কম্মো নয়। আর ওমুখো হননি।)। মানুষও যেন সে রকমই চাইছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ কেমন ভাবে জানি না, কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের খুব একটা পছন্দ করে না। যদিও সংকটে পড়লে তারা তাদের কাছেই যায়।

অধ্যাপক ইউনূসকে কী ধরনের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? তিনি একজন আন্তর্জাতিক সেলিব্রেটি। অনেক বড় মাপের মানুষ, অনেক বোদ্ধা একজন মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখতে এবং স্বপ্নের চাষ করতে ভালোবাসেন। বাংলাদেশের সংস্কার তাঁর একটা স্বপ্ন ছিল। বিদেশি মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে এ কথা তিনি বহুবার বলেছেন এবং বলেছেন, এই সংস্কার সম্পন্ন হলে তিনি আবার তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছেন তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে।

তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, তিনি রাজনীতি করবেন না ভবিষ্যতে। এ কথা আমি তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই লাগাতার বলে যাচ্ছি। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের প্রধান শাসককে এত বড় সার্টিফিকেট দেওয়া কি বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে? হয়তো না। কারণ, রাজনীতি বড় জটিল বিষয়। এখানে ম্যানি ম্যান, ম্যানি মাইন্ডস। গণতন্ত্র মানে সবার মতকে সম্মান দেখিয়ে অধিকাংশের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ ও দেশ পরিচালনা করা। খুব সহজ কাজ নয়। এমনিতেই মানুষের মস্তিষ্ক হলো সবচেয়ে জটিল এবং উন্নত পদার্থ। সেই রকম কোটি কোটি মানুষের মতকে সংশ্লেষণ করা যে কত কঠিন, তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কি একজন জটিল মনের মানুষ? কী জানি? সেই যে বাংলায় প্রবাদ আছে না, মনের কথা গোবিন্দ জানে। একজন গুণমুগ্ধ ছাত্র হিসেবে আমি তাঁকে যতটুকু চিনি, তিনি তা নন। তিনি কি জটিলতা-কুটিলতা ধরতে পারেন? তার মোকাবিলা করতে পারেন? আমার মনে হয় না। বরং এই ব্যাপারে তাঁকে জিরো মার্ক দেওয়া যেতে পারে।

মাত্র সাত দিন আগে যে প্রধান উপদেষ্টা বললেন, একটি দল বাদে এপ্রিল মাসে নির্বাচনের ব্যাপারে সবাই একমত (অর্থাৎ তিনি সরাসরি বিএনপিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছিলেন), সেই তিনিই আবার কেবল তাদের সঙ্গে বসে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করলেন! ছেলেমানুষি মনে হয় না?

৫ আগস্টের পর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য দেশে ফিরে বিমানবন্দরে যে রকম করে তিনি বললেন, ‘আমার কথা শুনতে হবে (হাসতে হাসতে বললেন, হুমকি দিয়ে নয়), না হলে আমি চলে যাব’, এর মধ্যে আর যা-ই থাক, ডিপ্লোমেসি নেই। অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যত দেশ ঘুরেছেন, যত বড় বড় কর্মকর্তা, নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁর কথার মধ্যে কৌশল থাকার কথা। আমি আগেও বিভিন্ন সময় বলেছি, ডক্টর ইউনূস খুব মিষ্টি করে কথা বলতে জানেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হয়। অথচ রাজনীতির ব্যাপারে তিনি একেবারেই কথা বলতে চান না; কিন্তু কথা তো তাঁকে বলতে হলো।

হ্যাঁ পাঠক, আমি লন্ডন বৈঠকের কথা বলছি। এই সংলাপের প্রাক্কালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, অধ্যাপক ইউনূসই লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। এখন সবাই বিশ্বাস করেন, মির্জা ফখরুল ঠিক কথা বলেছিলেন। অধ্যাপক ইউনূসের আগ্রহেই এই সংলাপ হয়েছিল এবং সেই সংলাপে তিনি হেরে গেছেন।

কথাটা একটু ব্যাখ্যা করে বলতে হয়। এখন মনে যা আসে, তা-ই বলা সমীচীন নয়। এখন এমন একটা সময়, যখন কোনো নেতা বা দল জিতল কি না, সেটা বড় কথা নয়; বড় কথা হলো, গণতন্ত্র জিতল কি না; দেশ জিতল কি না।

আমরা সত্যি সত্যি বাংলাদেশের ইতিহাসের, আরও স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের একটি বাঁকে অবস্থান করছি। জামায়াত, এনসিপিসহ দু-চারটি দলের একটি অভিমান আছে, অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে উপেক্ষা করে নির্বাচনের সময়-সংক্রান্ত এত বড় একটি সিদ্ধান্ত সরকার এককভাবে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিয়েছে এবং প্রটোকল ভেঙে তাদের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। জামায়াত এর প্রতিবাদে এক দিন ঐকমত্য কমিশনের সভাও বর্জন করেছে।

আমি জামায়াতসহ এই কয়েকটি রাজনৈতিক দলের এ-সংক্রান্ত সেন্টিমেন্টের সঙ্গে একমত। এই সিদ্ধান্ত সবাইকে স্পর্শ করেও করা যেত বলে আমার মনে হয়। এটা সরকারের বোঝার ভুল অথবা এ ধরনের একটি রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে হয়েছে।

মাত্র সাত দিন আগে যে প্রধান উপদেষ্টা বললেন, একটি দল বাদে এপ্রিল মাসে নির্বাচনের ব্যাপারে সবাই একমত (অর্থাৎ তিনি সরাসরি বিএনপিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য দায়ী করেছিলেন), সেই তিনিই আবার কেবল তাদের সঙ্গে বসে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করলেন! ছেলেমানুষি মনে হয় না?

আমাদের দল নাগরিক ঐক্য অথবা আমাদেরই জোট গণতন্ত্র মঞ্চকেও সরকার কোনো বিবেচনাতেই নেয়নি; কিন্তু আমরা কোনো সেন্টিমেন্ট দেখাইনি। আমাদের মনে হয়েছে, এই সরকার এসব সেন্টিমেন্টের মূল্য দিতে জানে না। নির্বাচনের সময় নিয়ে সরকার এবং বিএনপির মধ্যে যে সম্পর্কের অধঃপতন হচ্ছিল, তা বিপজ্জনক হতে পারত। লন্ডন সংলাপ সে বিপদটা কাটিয়ে দিয়েছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের যে বরফ জমতে শুরু করেছিল, তা গলে গেছে। নির্বাচন হবে নাকি হবে না বলে জনমনে যে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, তা দূর হয়েছে। এটাকেই আমি একটা বাঁক মনে করছি।

এখন রাজনৈতিক দলগুলোর আরও বেশি ধৈর্য ধরতে হবে, সহনশীল হতে হবে এবং কথাবার্তায় নম্রতা, যুক্তি, পরিমিতি এবং পরস্পরের সঙ্গে সৌহার্দ্য প্রদর্শন করতে হবে। তর্ক বা ঝগড়া করার মতো অনেক পয়েন্টই তৈরি করা যাবে, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না; বরং ক্ষতি হবে। ফ্যাসিবাদকে হটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য গুণগত মানসম্পন্ন নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সেই নির্বাচনের পর এই সরকারের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।

এ কারণে এই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানে ছায়ার বিরুদ্ধে লড়াই করা। সুখের বিষয়, ছোটখাটো মতান্তর বাদ দিলে রাজনৈতিক দলগুলো সেটা করছে না। গত ৮ আগস্ট এই অন্তর্বর্তী সরকারকে তারা যে সমর্থন দিয়েছিল, সেই সমর্থন এখনো অব্যাহত রেখেছে।

দুই.

লন্ডন বৈঠকের পর বরফ গলতে শুরু করেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ কি গলেছে? তা বলার অবকাশ অবশ্য তৈরি হয়নি। এ রকম হয়ও না। রাজনীতি সতত গতিশীল এবং দ্বন্দ্বমুখর। এখানে মতপার্থক্য, ধাক্কাধাক্কি হবেই। আর সামনে যদি থাকে ক্ষমতা বা নির্বাচন, তাহলে তো কথাই নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ব্যাপারটাই দেখেন। এখানে সরকার ও বিএনপি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। যা চলছে, তাকে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত বলা যেতে পারে না। একধরনের গা-জোরি এবং জেদাজেদি চলছে। অথচ লন্ডন বৈঠকের পর একটা সমঝোতা আশা করা গিয়েছিল।

 লন্ডন বৈঠকে, বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে একটা কথা বলা হয়েছিল। নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়ার সময় তারা আশা করেছিল, ইতিমধ্যে তিনটি বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হবে। প্রশ্ন আসে, এখানে সরকার আশা করবে কার থেকে? দায়িত্বটা তো প্রধানত সরকারের। সরকার অবশ্য সংস্কার এবং জুলাই সনদ তৈরির ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রত্যাশা করতে পারে।

১৭ জুন থেকে ঐকমত্য কমিশন দ্বিতীয় দফায় সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে। ৭০ ধারা এবং সংসদের কয়েকটি স্ট্যান্ডিং কমিটিতে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সভাপতি নির্বাচনের ব্যাপারে দলগুলো সম্মত হয়েছে। এটা একটা ভালো অগ্রগতি।

রাষ্ট্রপতি, উচ্চকক্ষ নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে মতভিন্নতার অবসান হয়নি। বলা হয়েছে, আলোচনা চলবে। এর আগের দিনের আলোচনায় সাংবিধানিক কাউন্সিল নিয়ে দলগুলো একমত হতে পারেনি।

এ ছাড়া নারী সদস্য ৫০ থেকে ১০০ জন করার ব্যাপারে একমত হলেও এই ১০০ জন কীভাবে নির্বাচিত হবেন, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। বিশ্লেষণ করে দেখলে, এর কারণে সংসদে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রশ্নটি ঝুলে আছে। আর তার অর্থ, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠনের প্রশ্নটিরও কোনো নিষ্পত্তি হয়নি।

সরকারের কাছে এই মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্ভবত জুলাই সনদ। গত বছরের জুলাই মাসে যে মহান ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার সনদ ঐকমত্যের ভিত্তিতে রচিত হবে এই বছরের জুলাইয়ে। খোদ অধ্যাপক ইউনূস বিদেশিদের কাছে বলেছেন, এই জুলাইয়ে সনদ হবেই।

পত্রিকায় দেখেছি, জুলাই অভ্যুত্থানের যাঁরা নায়ক ছিলেন, তাঁরা সবাই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। জুলাই অভ্যুত্থানে পরাজিত এবং দেশ থেকে বিতাড়িত শক্তি তাদের হারানো সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনার জন্য দেশের বাইরে গিয়ে অপতৎপরতায় লিপ্ত। একটা থ্রেট তো আছেই। ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ হবে তো?

ইতিমধ্যে জুলাই আন্দোলনে যাঁরা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মতপার্থক্যের ব্যাপারটা প্রকাশিত এবং সেটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দলগুলো আলাদা, এ জন্যই তাদের আলাদা মত আছে। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে সমগ্র জাতির প্রয়োজনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সেই থেকে এক বছর পার হয়ে গেছে। তাদের নিজেদের যে মতপার্থক্য, সেগুলো নিয়েই তো রাজনীতি শুরু হবে। তার মধ্যে সামনে জাতীয় নির্বাচন, যেটা প্রধানত প্রতিযোগিতার বিষয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়, এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হারিয়ে জেতার বিষয়। এ জন্যই ভয় যায় না, শঙ্কা কাটে না।

ভোট ঠিকঠাকমতো হবে তো?

ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো করে তো কিছু বলা যায় না। রাজনীতিতে সেটা উচিতও নয়। এখানে ভেরিয়েবল বেশি। তারপরও আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমি মনে করি সামনে যে বাধা, মতপার্থক্য আসবে, সেগুলো কাটিয়ে উঠে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। গণতন্ত্রের পাদপীঠে পৌঁছানোর জন্য যে পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া দরকার, সেগুলো দিতে পারব।

  • মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি

  • মতামত লেখকের নিজস্ব