১৭ বছর পর দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশে ফিরে তিনি নতুন দেশকে গড়ে তুলতে তাঁর যে একটা পরিকল্পনা আছে, সে কথা জানিয়েছেন। তিনি এমন একসময় প্রবাসজীবন শেষ করে দেশে ফিরেছেন, যখন দেশে মবতন্ত্র চলছে। যখন-তখন মব সংঘবদ্ধ হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। আমাদের সামনে এখন প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচী ভবনে হামলা, আগুন আর লুটের তরতাজা ছবি। দেশে প্রকাশ্যে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে। মানুষের মনে অবিশ্বাস ও আতঙ্কের ছায়া। পেছনে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ। নেতা–কর্মীদের ওপর নির্মম দমন–পীড়নের এক ভয়ংকর কালপর্ব অতিক্রমের তাজা স্মৃতি।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ লাখ লাখ মানুষকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। গুম, বিনা বিচারে হত্যার শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ।
ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, আমরা গণতন্ত্রে ফিরতে পারব কিনা বা পারলেও সেটি কবে। ২০২৪ সালে প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন; কিন্তু পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি; বরং বলা যায় মবপন্থীদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে সরকার।
দেশের মানুষের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। কয়েক দিন আগেই দিনদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে জুলাই আন্দোলনের মুখ শরিফ ওসমান বিন হাদিকে।
তারেক রহমানের নানা বক্তব্যে বোঝা যায়, তিনি একটি কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি না, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখতে হয়। সেই স্বপ্ন জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হয়। তারেক রহমান প্রতিনিয়ত সেই কাজই করে যাচ্ছেন।
এ রকম অনিশ্চয়তা ও অরাজক পরিস্থিতিতে দেশে ফিরেছেন তারেক রহমান। তারেক রহমানের দেশে ফেরা অপরিহার্য ছিল। তিনি এত দিন বিদেশ থেকে রাজনীতি পরিচালনা করছেন; কিন্তু দেশের মানুষ মনে করছে, এবার তিনি দেশে ফিরে সবকিছু আরও দক্ষভাবে পরিচালনা করবেন। তারা মনে করছে, তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে জনমতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কাজ করছেন এবং সবাইকে নিয়ে তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করবেন।
তারেক রহমান একগুচ্ছ রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে জনসাধারণের সামনে উপস্থিত হতে যাচ্ছেন। একটি কল্যাণমূলক জনবান্ধব রাষ্ট্রগঠনের পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই তিনি জাতির সামনে বিভিন্ন পর্যায়ে তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৩১ দফা ঘোষণার মাধ্যমে।
স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, প্রযুক্তিসহ নানা খাতের উন্নয়নের জন্য তিনি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন জনগণের ভোটে ক্ষমতায় যেতে পারলে। তিনি ফ্যামিলি কার্ড, ফারমার্স কার্ড, হেলথ কার্ড কর্মসূচি শুরু করার কথা বলেছেন। দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য শিক্ষা খাতকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা তাঁর রয়েছে। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের দুয়ার খোলার উদ্যোগ তিনি নেবেন।
সবাই আশা করছে, ফ্যাসিবাদ উত্তরকালে দেশে উন্নয়ন ও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন। বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মতোই তিনি সফল হবেন বলে মনে হচ্ছে।
রাজনৈতিক জীবনের অত্যন্ত কঠিন এক সময় পার হয়ে রাজনীতির এ পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছেন তারেক রহমান। তিনি যখন রাজনীতিতে আসেন, তখন একধরনের পরিবেশ ছিল; কিন্তু কিছু সময় পরেই রাজনীতির পরিবেশ বদলে যেতে শুরু করে। এরপর নানা চড়াই–উতরাইয়ের মধ্যে তাকে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হয়েছে।
রাজনীতিতে পদার্পণের কিছুদিনের মধ্যেই তারেক রহমানকে বিরূপ প্রচারণার মুখে পড়তে হয়। তাঁকে নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো। তারেক রহমানকে নিয়ে হেন কোনো অপপ্রচার নেই যা করা হয়নি। বেশ শক্তভাবেই তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছিল। তাঁর প্রতিপক্ষের লক্ষ্য ছিল শুরুতেই বিরূপ প্রচারণা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করা।
প্রথম দিকে তারেক রহমানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিছুটা সফলও হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারেক রহমানের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও কৌশলের কারণে এই বিরূপ প্রচারণা টিকতে পারেনি। এখনো তারেক রহমানকে নিয়ে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নানা ধরনের অপপ্রচার করছে। রাজনীতির শুরুর দিকে তারেক রহমানকে আওয়ামী লীগের অপপ্রচার মোকাবিলা করতে হয়েছে। এখন তিনি জামায়াতে ইসলামীর অনলাইন বাহিনীর অপপ্রচারের মুখে পড়েছেন।
তারেক রহমান সরাসরি কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। তবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার তিনি প্রবলভাবেই হয়েছেন। তাঁকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। ওই সময় তারেক রহমানের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তিনি এক পর্যায়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
মূলত এরপরই তারেক রহমানের জীবনে নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়। যদিও কাজটি অত্যন্ত কঠিন ও জটিল ছিল। বিদেশে বসে এত দূর থেকে রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা সহজ বিষয় ছিল না; কিন্তু এরপরও তিনি নিজেকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত রাখেন। মাঝখানে দীর্ঘ সময় দেশে তাঁর বক্তব্য প্রচার করতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই তাঁকে বিদেশে বসে রাজনীতি করতে হয়েছে।
তারেক রহমানের সব থেকে বড় রাজনৈতিক কৃতিত্ব হচ্ছে, আওয়ামী লীগের প্রবল চাপের মুখে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। দু-একজন ছোট ও মাঝারি সারির নেতা দল ত্যাগ করলেও মোটাদাগে বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হয়নি আওয়ামী লীগ। বিদেশে বসে দলের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ বজায় রেখে মনোবল ধরে রেখেছিলেন। ফলে নানা ধরনের চাপ ও ষড়যন্ত্রের মুখেও দল হিসেবে বিএনপি টিকে গেছে তারেক রহমানের নেতৃত্বে। কারান্তরীণ খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি তিনি বুঝতে দেননি।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও বিএনপি কয়েক দফা ভাঙনের মুখে পড়েছিল। সেবার তারেক রহমানের মা খালেদা জিয়া রাজনীতির মাঠে নেমে শক্ত হাতে বিএনপিকে পতনের মুখ থেকে তুলে আনেন। এবার তারেক রহমানের কৌশলী রাজনীতির কারণে বিএনপি রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্তভাবেই ধরে রেখেছে।
জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনীতির মধ্যে এক অদ্ভুত মিল আছে। তিনজনই দেশের চরম ক্রান্তিকালে দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ যখন অনিশ্চয়তার পাকচক্রে খাবি খাচ্ছে, তখনই জিয়াউর রহমান রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হন। নতুন রাজনীতি দিয়ে দেশকে সুসংগঠিত করেন। এরপর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।
এবার আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিদেশে বসে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারেক রহমান। তবে এবারের আন্দোলনের প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। প্রথম তারেক রহমান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আর ভয়ংকর ফ্যাসিবাদের কারণে একক ব্যক্তি বা দলের পক্ষে আন্দোলনকে সুসংগঠিত করা কঠিন ছিল; বরং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তারেক রহমান শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার নানা দিক আছে। তিনি বাল্যকালে বাবা জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে দেখেছেন। পরবর্তী সময়ে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছেন। নির্মমভাবে হত্যার শিকারও হতেও দেখেছেন জিয়াউর রহমানকে। রাজনীতির মাঠে মা খালেদা জিয়াকে সক্রিয় হতে দেখেছেন। দুই বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছেন। জেলেও যেতে দেখেছেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ভাইয়ের মৃত্যুও দেখেছেন।
ফলে রাজনীতির সুসময় যেমন তারেক রহমান অতিক্রম করেছেন, আবার অত্যন্ত কঠিন সময়ও তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। রাজনীতির নানা ঘটনাবহুল সময় অতিক্রম করে তিনি আজ এ পর্যায়ে এসে উপস্থিতি হয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তারেক রহমান যেমন ভালো গুণ আছে, তেমনি ত্রুটিও আছে। তিনি অবশ্যই ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে না। কোনো মানুষের পক্ষেই এটা সম্ভব নয়।
তারেক রহমানেরও নানা সীমাবদ্ধতা আছে। তাকে নিয়ে সমালোচনা আছে। রাজনীতিবিদদের নিয়ে সমালোচনা থাকবেই।
তারেক রহমানকে নিয়েও আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে শাসক হিসেবে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। তবে তারেক রহমানের রাজনৈতিক গুণাবলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি প্রতিহিংসাকে রাজনীতিতে স্থান দেননি। যৌবনের ভেঙেচুরে সব একাকার করে দেওয়ার অস্থির প্রবণতাকে অতিক্রম করে করে তিনি ধীর, স্থির, পরিপক্ব এক রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছেন।
শুরু থেকেই অকল্পনীয় অপপ্রচার, পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেসহ অগণিত নেতা–কর্মী জেলজুলুম ও নির্যাতনের শিকার হলেও ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর কোনো ধরনের প্রতিশোধ নেননি; বরং বিএনপির নেতা–কর্মীদের শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তিনি মনে করেন পরাজিত শক্তির ওপর প্রতিশোধ নিতে হয় না; বরং পরাজিতকে নিরাপত্তা দিতে হয়। রাষ্ট্রগঠনে সবার প্রতি সহনশীল আচরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতির পরিবর্তে তিনি গঠনমূলক রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। ৩১ দফা ঘোষণা করেছেন। জনবান্ধব রাষ্ট্রগঠনের নানা পরিকল্পনা নিয়ে তিনি দেশের মানুষের সামনে উপস্থিত হয়েছেন।
তারেক রহমানের নানা বক্তব্যে বোঝা যায়, তিনি একটি কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি না, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখতে হয়। সেই স্বপ্ন জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হয়। তারেক রহমান প্রতিনিয়ত সেই কাজই করে যাচ্ছেন।
ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব