বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। শিশু ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমেছে, টিকাদান কভারেজ বেড়েছে, অপুষ্টি কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে এবং গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার বিস্তৃতি ঘটেছে। তবে এসব অর্জনের মধ্যে ও একাধিক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিশেষত মাতৃমৃত্যু হার এখনো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) লক্ষ্য অর্জনের পথে বড় বাধা।
বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মরটালিটি সার্ভে ২০২২–এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখনো প্রায় ১৬৩ জন। এর মানে হলো, এক লাখ জীবিত সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ১৬৩ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার নামিয়ে আনতে হবে ৭০ জনে। অর্থাৎ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে, যা একবারেই দুরূহ।
বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা পরিচালিত হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের আওতায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি স্তরে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে রয়েছে ১৪ হাজার ৩৭১টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৪৩৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ৬৪টি জেলা হাসপাতাল। যদিও এই অবকাঠামো সেবার বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তবে অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পর্যাপ্ত জনবল, ওষুধ ও লজিস্টিকের ঘাটতি রয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেট প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় (পাকিস্তান ব্যতীত) সবচেয়ে কম। আরও উদ্বেগজনক হলো, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের প্রায় ৭৪ শতাংশই মানুষকে নিজ পকেট থেকে বহন করতে হচ্ছে। এই প্রবণতা বাড়ছে এবং এটি স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য ও আর্থিক ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে স্বাস্থ্যসেবায় আস্থাহীনতা ও রোগীর অসন্তুষ্টি এখনো বড় সমস্যা। প্রান্তিক ও দুর্গম অঞ্চলের নারীরা এখনো প্রসূতিসেবায় দেরি, চিকিৎসকের অনুপস্থিতি, হাসপাতালের ওষুধ–সংকট, ভঙ্গুর অবকাঠামো আর সেবাদাতাদের জবাবদিহির অভাবে ভোগেন, যা ন্যায্য ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার পথে এক কঠিন দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ (বিএইচডব্লিউ) স্বাস্থ্য খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গবেষণা, নীতিমালা পর্যালোচনা ও সমাধানের সুপারিশের কাজ করে আসছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি দুই বছর অন্তর সংস্থাটি মূলত সমসাময়িক স্বাস্থ্যবিষয়ক সংকট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা ‘বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ রিপোর্ট’ নামে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বহুল সমাদৃত একটি দলিল।
এই প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ ও করণীয় তুলে ধরা হয়ে থাকে। প্রথম প্রতিবেদনটি ছিল স্বাস্থ্য খাতে সমতা ও জবাবদিহি নিয়ে, যার মোড়ক উন্মোচনে উপস্থিত ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে গুরুত্ব পেয়েছে স্বাস্থ্য জনবল–সংকট, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি), নগর স্বাস্থ্য, অসংক্রামক রোগ (এনসিডিএস), রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, কোভিড-১৯ এবং সর্বশেষ জনস্বাস্থ্য শিক্ষা। এসব প্রতিবেদন শুধু জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ নয়, গণমাধ্যম ও বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যেও আলোচিত হয়েছে এবং দেশের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।
এই রিপোর্টের পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে স্থানীয় পর্যায়ের সেবার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ (বিএইচডব্লিউ) একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সুইডিশ উন্নয়ন সংস্থা সিডার সহযোগিতায় দেশের আটটি বিভাগের আটটি জেলায় গঠিত রিজিওনাল চ্যাপ্টারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম (এইচআরএফ) ও যুব স্বাস্থ্য অধিকার ফোরাম (এইচআরওয়াইএফ)।
এসব ফোরাম গড়ে উঠেছে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে। যারা নাগরিক ও সরকারি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করেছে। যেখানে সম্মিলিতভাবে সবার আলোচনার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা পরিবর্তনের পক্ষে ভূমিকা রাখছে।
স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামগুলো নারী, তরুণ, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। তারা নিয়মিত হাসপাতাল পরিদর্শন করছেন, জনশুনানির আয়োজন করছেন এবং সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছেন। এই সবকিছুই হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে।
নাগরিকেরা এখন তাদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার একটি প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা সেবাগ্রহীতার স্বাস্থ্য অধিকারের বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হয়েছে।
সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আশাব্যঞ্জক ফলাফল। গবেষণার পাশাপাশি স্থানীয় অভিজ্ঞতাও প্রমাণ করছে, এই ফোরামগুলো বাস্তব কিছু পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। খাগড়াছড়ির এক সেবাগ্রহীতা বলেন, আগে সকালেই ডাক্তার দেখার জন্য হুড়াহুড়ি করতে হতো। এখন বিকেলেও ডাক্তার পাওয়া যায়, সেবা গ্রহণে অপেক্ষার সময়ও কমেছে অনেক।
বরগুনার একজন ফোরাম সদস্য বলেন, একসময় হাসপাতালে ৫০ জনের খাবার ২৫০ জনে ভাগাভাগি করে খেতে হতো; কিন্তু আমাদের উদ্যোগের ফলে জেলা প্রশাসক ব্যবস্থা নিয়ে এখন ২৫০ জনের জন্য পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করেছেন।
এমন অভিজ্ঞতা কেবল সুবিধাভোগীর নয়; বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। জনগণ যখন শুধু ভোক্তা নয় বরং কার্যকর অংশগ্রহণকারী হয়, তখন স্বাস্থ্যসেবা স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপ নিতে শুরু করে।
স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামগুলো নারী, তরুণ, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। তারা নিয়মিত হাসপাতাল পরিদর্শন করছেন, জনশুনানির আয়োজন করছেন এবং সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছেন। এই সবকিছুই হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে।
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের এক প্রকল্প ব্যবস্থাপক যথার্থই বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় মানুষের কণ্ঠস্বর কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণে পৌঁছে দেওয়া এবং এর মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যা সমাধান করা।’ উদাহরণস্বরূপ, সংবাদমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকার কথা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ স্থানীয় সংবাদকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
এতে করে তারা সমস্যার বিষয় সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেমন বাগেরহাটের শরণখোলায় চিকিৎসক–সংকটের বিষয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পরবর্তী সময়ে ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এর ফলে শরণখোলায় চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এভাবে ছোট ছোট সাফল্যের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে স্বাস্থ্যসেবায় বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব।
তবে ইতিবাচক অর্জনের মধে৵ও চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট। গবেষণায় দেখা গেছে, ফোরামগুলো এখনো সরকারি স্বীকৃতি পায়নি, ফলে অনেক সময় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা তাঁদের কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেন না। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ঘাটতি, অর্থ ও লজিস্টিক সহযোগিতার অভাব এবং স্বাস্থ্য খাতের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কার্যক্রমকে দীর্ঘ মেয়াদে সীমিত করে রাখছে।
এই উদ্যোগকে টেকসই করতে হলে ফোরামগুলোকে আইনি স্বীকৃতি দিতে হবে, স্থানীয় প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, সদস্যদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং সবচেয়ে জরুরি হলো টেকসই অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ আমাদের একটি বড় সত্যের সামনে দাঁড় করায়—স্বাস্থ্যসেবা কেবল অবকাঠামো কিংবা বাজেটের প্রশ্ন নয়, এটি মানুষের অংশগ্রহণ, অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নও। স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে ওঠা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামগুলো দেখিয়ে দিয়েছে, সাধারণ মানুষ যদি কণ্ঠস্বর তোলে, তবে হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে ওষুধের সরবরাহ এবং চিকিৎসকের সময়মতো উপস্থিতি—সবকিছুরই দৃশ্যমান পরিবর্তন সম্ভব। নারী, তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি এই পরিবর্তনকে করেছে আরও টেকসই ও অর্থবহ।
কিন্তু এখানেই থেমে থাকা যাবে না। সরকারি স্বীকৃতির অভাব, প্রশিক্ষণের ঘাটতি এবং আর্থিক সংকটের মতো চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে এখনই। না হলে অর্জিত সাফল্য মাঝপথেই থেমে যেতে পারে।
আজ প্রশ্ন একটাই—আমরা কি এই অগ্রযাত্রাকে সাময়িক সাফল্যের গল্প হিসেবে রেখে দেবো, নাকি এটিকে আইনি স্বীকৃতি, সরকারের বর্তমান কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং টেকসই অর্থসংস্থানের মাধ্যমে জাতীয় মডেলে রূপান্তর করব? উত্তর খুঁজে বের করতে হবে আজই। কারণ, স্বাস্থ্য অধিকার শুধু একটি নীতি নয়, এটি মানুষের মৌলিক অধিকার—আর সেই অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণের অংশগ্রহণের বিকল্প নেই।
মাহরুবা খানম গবেষণা সমন্বয়ক, বাংলাদশে হেলথ ওয়াচ
ই–মেইল: mahruba.khanam@bracu.ac.bd