Thank you for trying Sticky AMP!!

গুমের অভিযোগ নিয়ে বিভ্রান্তি কেন?

হঠাৎ করে গুমের অভিযোগ নিয়ে জোর বিভ্রান্তি তৈরির একটা লক্ষণ ক্রমশই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের পক্ষ থেকে গুমের অভিযোগ নাকচ করা ও অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে পাল্টা রাজনৈতিক অভিযোগ করা নতুন কিছু নয়। গুমের শিকার হতভাগ্য মানুষগুলো ভূমধ্যসাগরে ডুবে গেছে, এমন অসংবেদনশীল ও নিষ্ঠুর মন্তব্যও আমরা শুনেছি। কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের সফর ও তার পরের বিবৃতির পর বিষয়টি নিয়ে নতুন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এসব প্রশ্নের কয়েকটি এসেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম থেকে।

ভারতের ইন্ডিয়া টুডে-এর অনলাইনে গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রথম প্রশ্ন করা হয় যে মণিপুরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা রাজকুমার ওরফে মেঘেন এবং কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র ওরফে শিলহেইবাকে গুম হিসেবে দেখানো হয়েছে জাতিসংঘের গুমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটির তালিকায়। অথচ ওই দুজনের মধ্যে রাজকুমার এখন মণিপুরে নিজের বাড়িতে সস্ত্রীক বসবাস করছেন এবং কেইথেল্লাকপাম ২০১৫ সালে বিহারে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে ভারতের কারাগারে বন্দী আছেন এবং তাঁদের অন্তর্ধানের যে সময় ও স্থানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কমিটি, ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স, ডব্লিউজিআইইডির তথ্যের উৎস হচ্ছে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা অধিকার।

সপ্তাহখানেক পর একই অনলাইন পোর্টাল বিষয়টি নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাতে নতুন কোনো তথ্য না দিয়ে কয়েকজনের বিশ্লেষণমূলক মন্তব্য ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে সম্প্রতি প্রায় চার সপ্তাহ নিখোঁজ থাকা রহিমা বেগমের ফিরে আসার নাটকীয় কাহিনিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন কারণে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে যাওয়া ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে সরকারি বাহিনী বা সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখার অভিযোগের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার এ প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। তবে রহিমা বেগমের ঘটনার পর এখন তা নতুন মাত্রা পেয়েছে।  

গুম থেকে ফিরে আসা মানুষগুলোর ৯৯ শতাংশই যে কোনো কথা বলেন না, তার কারণ কি তাহলে মুচলেকা আদায়? গুমের অভিযোগ উঠলে গুমের শিকার ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ ছিল, তাঁর একটা ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। যার মানে হচ্ছে, তাঁরা মনে করেন কথিত খারাপ লোক গুম হওয়ায় সমাজের উপকার হচ্ছে। এই যুক্তির ভয়াবহ দিক হচ্ছে বিনা বিচারে অপরাধীকরণ।

গুমের তালিকায় ভারতীয় দুজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার নাম থাকার বিষয়টি নতুন নয়। বরং নতুন হচ্ছে এখন এটিকে বড় করে বিতর্ক তৈরির চেষ্টা। সানায়াইমা রাজকুমারকে ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ সে সময়েই বাংলাদেশের সব পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানায় তখন যে মামলা হয়েছিল, তার কপি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সংগ্রহে রয়েছে। গুমের তালিকা শুধু অধিকার নয়, আইন সালিশ কেন্দ্র থেকেও তখন করা হতো। কদিন আগে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন তাদের কাছে ১১৩ জনের গুমের অভিযোগ এসেছে। মানবাধিকার নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করে, তাদের তথ্যের প্রাথমিক সূত্র হচ্ছে সংবাদপত্র। অপর ভারতীয় কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্রকে ঢাকায় তুলে নিয়ে যাওয়ার খবরও বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সাদাপোশাকের পুলিশ ও গোয়েন্দারা তুলে নিয়ে যায় এবং তাঁকে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের হাতে তুলে দেওয়ার খবর প্রকাশ পাওয়ার কথা ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনেও উল্লেখ রয়েছে। সেখানে ভারত ও বাংলাদেশের সরকার দুটির ওই তথ্য নাকচ করে দেওয়ার কথাও আছে। গুমের তালিকায় তাঁদের নাম থাকা তাই মোটেও অস্বাভাবিক নয়।

Also Read: গুমের শিকার পরিবারগুলোর দুঃখের কথা শুনুন

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগের কয়েকটি গুমের ঘটনা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যেন সেগুলোর সত্য উদ্‌ঘাটনে রাষ্ট্রের কোনো দায় নেই। আবার এমন কথাও বলা হয়েছে যে তালিকায় নাম আছে এমন কেউ কেউ এখন বিএনপির মিছিল করছেন। এ ধরনের বক্তব্যে প্রশ্ন জাগে, গুম অবস্থায় কি তাঁদের কাছ থেকে মিছিল না করার মুচলেকা নেওয়া হয়েছিল?

গুম থেকে ফিরে আসা মানুষগুলোর ৯৯ শতাংশই যে কোনো কথা বলেন না, তার কারণ কি তাহলে মুচলেকা আদায়? গুমের অভিযোগ উঠলে গুমের শিকার ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ ছিল, তাঁর একটা ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। যার মানে হচ্ছে, তাঁরা মনে করেন কথিত খারাপ লোক গুম হওয়ায় সমাজের উপকার হচ্ছে। এই যুক্তির ভয়াবহ দিক হচ্ছে বিনা বিচারে অপরাধীকরণ। অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁর নিরপরাধ বিবেচিত হওয়ার যে সাংবিধানিক অধিকার, তা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা আইনের শাসনের পরিপন্থী। গুমকে যৌক্তিকতা দেওয়া আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার সমতুল্য। উপরন্তু, গুমের শিকার ব্যক্তিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ যেহেতু বিরোধী দলের সদস্য, সেহেতু এটি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূল করার কৌশল হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সরকারকে বিব্রত করতে ও রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার উদ্দেশ্যে গুমের ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে বলে যে দাবি সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকেরা করে চলেছেন, তা প্রমাণ করতে হলেও প্রয়োজন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত। অভিযোগকারীদের চরিত্রহনন, তাঁরা ফিরে এসে বিএনপির মিছিলে যোগ দিচ্ছেন বলে পাল্টা অভিযোগ এবং তাঁদের পরিবার-স্বজনদের হয়রানি বরং সন্দেহ গভীর করে তোলে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ কমিটি কিন্তু কোনো অভিযোগ সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি, সরকারের কাছে তথ্য চেয়েছে এবং স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। বিতর্ক না বাড়িয়ে তাই উচিত হবে দ্রুত সেই তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক