একসময় দেশে শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানেই প্রকৌশল ও কারিগরি খাতে পড়াশোনা করা যেত। বর্তমানে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট আছে, যেখানে প্রকৌশলে স্নাতক অথবা ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেওয়া হয়। পরিসংখ্যান মতে, সরকারি ও প্রাইভেট মিলিয়ে স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রসংখ্যা দুই লাখের মতো। ডিপ্লোমা পর্যায়ে ছাত্রসংখ্যা প্রায় চার লাখ।
প্রকৃতপক্ষে ছাত্রসংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। এর একটি ক্ষুদ্র অংশই সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারবে। এই সংখ্যা ৫ শতাংশের কম। এই ৫ শতাংশ চাকরি নিয়েই ডিপ্লোমা ও স্নাতক প্রকৌশলীদের মধ্যে দ্বৈরথ চলছে। কারণ, সরকারি চাকরিতে এ দুই দলের অবস্থানের ওপর তাদের মানমর্যাদা নির্ভর করে বলে ধারণা করা হয়।
প্রকৌশল ও কারিগরি খাতে যাঁরা পড়াশোনা করতে এসেছেন, এখন সময় হয়েছে তাঁদের মান নিয়ে চিন্তাভাবনা করার। তাঁদের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারলে দেশের কারিগরি খাতে বিপ্লব সাধিত হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে দক্ষতাসম্পন্ন অতিরিক্ত জনশক্তিকে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিদেশের শ্রমবাজারে রপ্তানি করা গেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। দেশের অর্থনৈতিক মন্দার সময় প্রবাসীদের পাঠানো এই রেমিট্যান্সই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। তাই সরকারের উচিত প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা এবং এই খাতের শিক্ষার্থীরা যাতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, সেই কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।
প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার্থীদের মেধা আর দক্ষতা নিয়ে অনেক কথা হয়। কর্মক্ষেত্রে সারা জীবনই মেধার প্রয়োজন আছে। তবে শুধু মেধাবী হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, দক্ষতা ছাড়া কর্মজীবনে সফল হওয়া যায় না। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই দক্ষ রেডিমেড জনশক্তি তৈরি করে না। তবে দক্ষতা অর্জনের জন্য যে প্রতিষ্ঠানিক জ্ঞান দরকার, তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেলে যিনি মেধাবী, তাঁর পক্ষেই অধিকতর দক্ষ হওয়া সম্ভব।
ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা দাবি করে থাকেন, তাঁরা হাতে–কলমের কাজে দক্ষ। তবে এই দক্ষতা তাঁরা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে নিয়ে আসেন না, চাকরিতে যোগদানের পর অর্জন করেন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোয় ল্যাব ফ্যাসিলিটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনেক কম। কাজেই সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি দক্ষতা অর্জনের সুযোগ নেই।
দক্ষতা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ফলাফলই নতুন চাকরিতে নিয়োগের মানদণ্ড হওয়া উচিত। নিয়োগকৃতদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের দায়িত্ব নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের। প্রযুক্তি নিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য উন্নত বিশ্বের একজন প্রকৌশলীসহ করিগরি খাতের সবাইকে প্রায় সারা জীবনই পেশাগত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সাফল্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করে তাঁরা সনদ ও লাইসেন্স অর্জন করেন। লাইসেন্স না থাকলে প্রকৌশল ও কারিগরি খাতে চাকরি করা যায় না। আমাদের এখন বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর কারিকুলামকে আধুনিকায়নসহ পেশাক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক লাইসেন্সিংয়ের বিধান প্রবর্তনের চিন্তা করা দরকার।
বর্তমানে দেশের প্রকৌশল খাতে ৮০ শতাংশ কাজই ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা করে থাকেন। কিন্তু অনুমান করা যায়, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে উৎপাদন ও অবকাঠামো খাতে রুটিন কাজে ব্যাপক অটোমেশন হবে। তখন প্রকৌশল খাতে সৃজনশীল চিন্তা ও ডিজাইন বিশ্লেষণমূলক কাজ হবে বেশি। প্রকৌশলের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর ভালো দখল না থাকলে তখন উদ্ভূত কারিগরি সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বিষয়টি মাথায় রেখে সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর না হলে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়তে পারে।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক গবেষণায় বলেছে, সরকারের কিছু শর্টকাট নীতি দেশের কারিগরি খাতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এই শর্টকাট পথে কারিগরি শিক্ষায় মৌলিক জ্ঞান অর্জনে ঘাটতি থেকে যায় এবং এর গ্লানি ডিপ্লোমাধারীদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। মাধ্যমিক শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে ডিপ্লোমা অর্জনের জন্য চার বছর ব্যয় করা একটি অপচয়মূলক প্রথা।
ডিপ্লোমা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। এই বাধা দূর করতে চাইলে মাধ্যমিক শিক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার সংক্ষিপ্ত পথ পরিহার করতে হবে। ১২ বছর মেয়াদি মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ফেললে পলিটেকনিক হোক বা বিশ্ববিদ্যালয় হোক, উচ্চশিক্ষার পথ সবার জন্য সমান উন্মুক্ত থাকে। মৌলিক জ্ঞান ও ম্যাচিউরিটি অর্জনে সুযোগের তারতম্য কমে আসে।
সব উন্নত দেশে কারিগরি ধারায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। কোনো কোনো দেশে ৬৫ শতাংশ ছাত্রই কারিগরি ধারার শিক্ষার্থী হয়। বাংলাদেশে এই হার ৫ শতাংশের কম। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত কেরানি তৈরি করার শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করতে চাইলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে; কারিগর তৈরির শিক্ষাব্যবস্থায় পরিণত করতে হবে। এর উপায় হলো মাধ্যমিক পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার ধারাকে মূলধারা হিসেবে গ্রহণ করা। আমরা এমন শিক্ষাব্যবস্থাকে মূলধারা হিসেবে রাখতে পারি না, যা অধিক সংখ্যায় বেকার তৈরি করে।
জাতীয় দক্ষতা নীতিমালা বা কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক অনুসারে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের দক্ষতামান ৭, ডিপ্লোমাধারীদের দক্ষতামান ৬ আর উচ্চমাধ্যমিক সনদ অর্জনকারীদের দক্ষতামান ৫। কারিগরি শিক্ষায় সংক্ষিপ্ত পথ অনুসরণ করায় ডিপ্লোমাধারীদের সঙ্গে নিচের ও ওপরের স্তরের দক্ষতামান ও শিক্ষার সমন্বয়ে গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হয়। এর বিরূপ প্রভাব চাকরির ক্ষেত্রেও দেখা যায়। কোনো কোনো সংস্থায় উচ্চ দক্ষতামানধারী বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের প্রকৌশলে ডিপ্লোমাধারীদের চেয়ে নিচের বেতন স্কেলে পদায়ন করতে দেখা যায়। বিষয়টি মৌলিক ন্যায়বিচারের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোয় প্রথম দুই বছরে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির সিলেবাস সম্পন্ন করে এইচএসসি (ভোক) সনদ নিয়ে আগে জাতীয় দক্ষতামান ৫ অর্জন করা দরকার। এতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলো থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট অথবা টেকনিক্যাল কলেজ থেকে এইচএসসি (ভোক) সনদ নিয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোয় দুই বা তিন বছর মেয়াদি কারিগরি ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে জাতীয় দক্ষতামান ৬ অর্জন করলে শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে দক্ষতামান ৭ অর্জনের পথে আর কোনো বাধা থাকে না। এ ব্যবস্থা উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে অধিকতর সংগতিপূর্ণ হয়।
বর্তমানে দেশের প্রকৌশল খাতে ৮০ শতাংশ কাজই ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা করে থাকেন। কিন্তু অনুমান করা যায়, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরে উৎপাদন ও অবকাঠামো খাতে রুটিন কাজে ব্যাপক অটোমেশন হবে। তখন প্রকৌশল খাতে সৃজনশীল চিন্তা ও ডিজাইন বিশ্লেষণমূলক কাজ হবে বেশি। প্রকৌশলের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর ভালো দখল না থাকলে তখন উদ্ভূত কারিগরি সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বিষয়টি মাথায় রেখে সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর না হলে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়তে পারে।
প্রকৌশল পেশায় স্নাতক ও ডিপ্লোমাধারীদের পেশাগত দাবিগুলোর যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে সম্প্রতি সরকার চারজন উপদেষ্টাসহ আট সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করেছে।
এই কমিটিকে সহায়তাদানের জন্য প্রায় সব অংশীজনের সমন্বয়ে বড় আকারের একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। এই কমিটির উচিত হবে প্রথমেই কারিগরি খাতের মূল সমস্যাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। তারপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে এই খাতের সঠিক বিকাশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য স্থির করা। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রকৌশল ও কারিগরি খাতের চলমান পেশাগত সংকট নিরসনের চেষ্টা হলে সেটা হবে বেশি টেকসই।
মাহবুবুর রাজ্জাক অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট
mmrazzaque@me.buet.ac.bd