Thank you for trying Sticky AMP!!

জাফর ভাইয়ের স্মৃতি: বিচিত্রা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

জাফর (ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী) ভাইয়ের মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, অভিভাবক, সুহৃদ বন্ধু হারালাম। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও হারিয়েছে। শোকে পাথর হয়ে গিয়েছি। মনে পড়ছে অনেক কথা।

সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যোগ দেওয়ার পরপর, ১৯৭৮ সালে তাঁর এক দীর্ঘ চিঠি পেয়েছিলাম। সুন্দর হাতের লেখা ছয়-সাত পৃষ্ঠার চিঠি। তাঁর সম্বন্ধে আগেই জানতাম বিচিত্রার সুবাদে। আবার স্নাতকোত্তর পরীক্ষার পর জাতিসংঘের এক পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্পে চাকরি করতে ধামরাই ছিলাম ছয় মাস। তখন আমার এক সহকর্মী ছিলেন, যিনি আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করতেন। তাঁর কাছেও জাফর ভাইয়ের কথা শুনি। চিঠিতে জাফর ভাই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ত্রুটি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কারসাজির বিস্তারিত লিখেছিলেন।

কিছুদিন পর, জাফর ভাই বিচিত্রা কার্যালয়ে এলে পরিচয় হয়। প্রথম পরিচয়েই আন্তরিকতা হওয়ার কথা, হয়েছিলও তা-ই। তারপর অগণিতবার জাফর ভাইয়ের সঙ্গে বয়োকনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে, সাংবাদিক হিসেবে, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ছায়ার মতো পাশে থেকে কাজ করেছি।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন তখনকার বিএনপি সরকারের মন্ত্রীদের অনেকে। সে পরিস্থিতিতে জাফর ভাই একদিন বিচিত্রার আড্ডায় প্রস্তাব করলেন, ছোট ছোট দল ও স্বনামধন্য ব্যক্তিদের নিয়ে ‘নাগরিক কমিটি’ করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার। সেখানে ঠিক হলো, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী হবেন আমাদের প্রার্থী। জাফর ভাই তাঁকে রাজি করানোর দায়িত্ব নিলেন।

ওষুধনীতি-সংক্রান্ত আইন জারির পর তা বানচালের জন্য শুরু হলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর খেলা। বিচিত্রায় ক্রমাগত প্রতিবেদন লিখতে থাকলাম। একটি প্রতিবেদনে এক কোম্পানির ওষুধের নাম ভুল লিখেছিলাম। সে জন্য প্রেস কাউন্সিলে মামলা হয়ে গেল। আমরা হেরে যাব এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জাফর ভাই একরাত খেটে এমন তথ্য বের করলেন যে সেই কোম্পানির অভিযোগ জোলো হয়ে গেল।

সে সময় বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতাম আমি, আলোচনায় তাঁর সঙ্গে আমিও থাকতাম। আমার ভূমিকা জাফর ভাইকে সঙ্গ দেওয়া এবং দুই আলোচনার মধ্যবর্তী সময়ে নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করা। সে সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ শেষ মুহূর্তে তাদের সিদ্ধান্ত বদলিয়ে ড. কামাল হোসেনকে প্রার্থী করে। অর্থের অভাবে নাগরিক কমিটির নির্বাচনী প্রচারণা শেষ পর্যন্ত থমকে গিয়েছিল। প্রথম দিকে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল জাফর ভাইয়ের বক্তৃতা।

নির্বাচনে ওসমানী হেরে গেলেও জাফর ভাই বসে থাকার মানুষ নন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এরশাদ সামরিক শাসন জারি করেন। জাফর ভাই তাঁকে বোঝালেন, গণমুখী ওষুধনীতি করলে সামরিক সরকার জনপ্রিয় হয়ে যাবে। শুরু হলো ওষুধনীতির কাজ। সরকারি আদেশ জারির কয়েক দিন আগে তখনকার পিজি হাসপাতালে ডা. নুরুল ইসলামের কামরায় তিনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান ও জাফর ভাইয়ের যৌথ সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো বিচিত্রার প্রচ্ছদ কাহিনির জন্য।

Also Read: জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদের বিদায়

ওষুধনীতি-সংক্রান্ত আইন জারির পর তা বানচালের জন্য শুরু হলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর খেলা। বিচিত্রায় ক্রমাগত প্রতিবেদন লিখতে থাকলাম। একটি প্রতিবেদনে এক কোম্পানির ওষুধের নাম ভুল লিখেছিলাম। সে জন্য প্রেস কাউন্সিলে মামলা হয়ে গেল। আমরা হেরে যাব এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জাফর ভাই একরাত খেটে এমন তথ্য বের করলেন যে সেই কোম্পানির অভিযোগ জোলো হয়ে গেল। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আদালত অবমাননার মামলায় জাফর ভাই ক্ষমা প্রার্থনা না করে যে জবাব দিয়েছিলেন, তা একটা দারুণ লেখা।) আমরা সমঝোতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করে ফেললাম। মনে রাখতে হবে, তখন গুগল বলে কিছু ছিল না। জাফর ভাই ছিলেন বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিশ্বকোষ।

কিছুদিন পর, জাফর ভাই আমাকে একটা বই দিলেন, কীটনাশকের ভয়াবহতা নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে লেখা ‘ডার্টি ডজন’। বইটায় ১২টি কীটনাশকের ভয়াবহতা জেনে বাংলাদেশে সেগুলোর বাজার সম্বন্ধে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বিচিত্রায় প্রচ্ছদ কাহিনি লিখি।

সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রচ্ছদে জাফরুল্লাহ চৌধুরী

জাফর ভাই মাঝেমধ্যে সাভার যাওয়ার পথে আমার বেইলি রোডের বাসায় কফি খেতে আসতেন। একদিন কফি খেতে খেতে ভুল চিকিৎসার গল্প করছিলেন। জানলাম, পিজি হাসপাতালে গলগণ্ডের অস্ত্রোপচারের সময় একই দিনে চারজন রোগী মারা যান। খবরটার আরও বিস্তারিত দিতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি কিছুতেই তা দিতে রাজি হলেন না। অবাক হয়ে নিজে অনুসন্ধান চালানোর অনুমতি চাইলাম, তাতে আপত্তি করেননি। খবরটা বিচিত্রায় ছাপা হওয়ার পর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এক সভায় এর প্রতিবাদ করেন এবং কোনো চিকিৎসক আমার বা আমার পরিবার সদস্যের চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানতে পারি।

জাফর ভাইয়ের বিরুদ্ধে নানা রকম আক্রমণ-ষড়যন্ত্র চলছিল। ফার্মাসিউটিক্যালসে হামলা চালানো হলো। তখন বেশ কয়েক রাতে তাঁকে সাভারে পৌঁছে দিয়েছি। তাঁর বিশ্বস্ত গাড়িচালক মোস্তফা তখন সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকতেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সাংবাদিকতার কাজে ব্যস্ত থাকায় এবং নানা কারণে জাফর ভাইয়ের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তিনিও ফার্মাসিউটিক্যালস ও গণস্বাস্থ্যের নগর হাসপাতালের কাজে খুব ব্যস্ত থাকতেন।

Also Read: আমাদের উন্নয়ন ভাবনা ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

এরশাদ সরকারের পতনের পরপর আমি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে যোগ দেওয়ার জন্য বিলাতে চলে আসি। বছর তিনেক পর জাফর ভাই একদিন বুশ হাউসের বিবিসি কার্যালয়ে আসেন, পলিটিকস অব এসেনশিয়াল ড্রাগস নামে তাঁর লেখা বই জেড পাবলিশার্স প্রকাশ করেছে। এর প্রকাশনা উপলক্ষে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। পরের দিন সারা দিন তিনি আমার বাসায় থাকলেন।

মাঝে বেশ কয়েক বছর জাফর ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। আমি ইতিমধ্যে সাংবাদিকতা ছেড়ে প্রোগ্রামার হিসেবে ব্রিটিশ স্বাস্থ্য বিভাগ এনএইচএসে যোগ দিয়েছি। আমাদের হাসপাতালের একজন শল্যবিশেষজ্ঞ তাঁদের একটি দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বৃক্ক (কিডনি) প্রতিস্থাপনের প্রশিক্ষণ দেন। জাফর ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে এ ব্যবস্থা করা যায় কি না। তিনি সোৎসাহে রাজি হলেন। তাঁদের সঙ্গে চুক্তির খসড়া লিখে দুই পক্ষের সম্মতি নিলাম। জাফর ভাই বিলাতে এসে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে গেলেন। দুজন বিশেষজ্ঞ শল্যবিদকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় গেলাম, তাঁরা সবকিছু দেখে মন্তব্য করলেন, কমপক্ষে চারটি রক্ত শোধন (ডায়ালাইসিস) যন্ত্র অস্ত্রোপচার কক্ষের সঙ্গে একই দালানে থাকতে হবে। গণস্বাস্থ্যের তা ছিল না বলে প্রকল্পটা শুরু হলো না। কিন্তু জাফর ভাই ঢাকায় ১০০টি ডায়ালাইসিস যন্ত্রের কেন্দ্র বসানোর প্রতিজ্ঞা করে বসলেন। সেই কেন্দ্র চালু করার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যেতে পারিনি। কেন্দ্রটি এখন চলছে।

গত বছর তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে। জাফর ভাই একটা বই লেখার প্রস্তাব দিলেন। বললাম লিখব, আপনার জীবনী, হেসে উড়িয়ে দিলেন। জানতাম, আমি ঢাকায় থাকলে অবশ্যই সময় দিতেন।

আমরা, তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বলতাম, জাফর ভাইয়ের চার প্রেম—প্রথম প্রেম গণস্বাস্থ্য, দ্বিতীয় প্রেম সংবাদপত্র, তৃতীয় প্রেম রাজনীতি এবং চতুর্থ প্রেম তাঁর স্ত্রী। জাফর ভাইয়ের সান্নিধ্যে ধন্য ছিলাম সমাজের অগ্রগামী অংশের সঙ্গে আছি ভেবে। তাঁর জীবনের দৃষ্টান্ত থেকে বাংলাদেশের মানুষ শক্তি ও প্রেরণা সংগ্রহ করুক।

  • কাজী জাওয়াদ সাংবাদিক ও লেখক