মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য আইনি কাঠামো দরকার

অভিবাসন খাতে জবাবদিহি

বাংলাদেশের অনেক মানুষ নানা কারণে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসী হতে চায়। অনেকের কাছে ইউরোপ–আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাওয়া বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। এমন নয় যে যাঁরা অভিবাসী হন, স্বদেশের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন হয়ে যায়। বরং স্বদেশে রয়ে যাওয়া স্বজনদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ও যোগাযোগ থেকে যায়; তাঁদের উপার্জিত অর্থের একটি অংশ দেশে পাঠান। আবার অনেকে বিদেশে যান কর্মসংস্থানের আশায়। এই অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত। কেউ কেউ বিদেশে অর্থ উপার্জন করে একপর্যায়ে স্বদেশে ফিরে সৃজনশীল নানা অর্থনৈতিক উদ্যোগ শুরু করেন।

কিন্তু অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ নয়; সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিয়মকানুন যথাযথভাবে অনুসরণ করে বৈধ অভিবাসী হওয়া একটি দীর্ঘ, ঝক্কি–ঝামেলাপূর্ণ ও ব্যয়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। অভিবাসী হতে ইচ্ছুক অনেক বাংলাদেশি নাগরিক অভিবাসন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেন। তাঁদের বলা হয় মধ্যস্বত্বভোগী। গত ২৮ এপ্রিল রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) নামের একটি সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত ‘অভিবাসন ও সোনার মানুষ সম্মিলন’–এ বক্তারা বলেন, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে বৈধতা দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, অভিবাসন খাতের সব বিষয়কে একটা পদ্ধতির মধ্যে আনা দরকার, যাতে সবার জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। আমরা জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। কারণ, জবাবদিহি নিশ্চিত করা হলে অভিবাসন খাতে প্রতারণা বন্ধ করা সম্ভব হবে। ওই সম্মিলনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। যাঁরা বিদেশে যেতে চান, তাঁরা মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপরে বেশি নির্ভরশীল, আর মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নজরদারি নেই বলে তাঁরা সহজেই বিদেশে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছ থেকে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে থাকেন। তাঁদের আইনি কাঠামোর আওতায় এনে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হলে তাঁরা এটা করতে পারবেন না।

বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ও অভিবাসন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি খাতের প্রাধান্য বেশি, সরকারি নজরদারি দুর্বল। ফলে এ দেশ থেকে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। সরকারি নজরদারি বাড়ানো হলে টাকা পাচার রোধ করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া যথাযথ অভিবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত হলে এসডিজি অর্জনে ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ১১টি অর্জন করা সহজ হবে। সুতরাং অভিবাসন খাতের মধ্যস্বত্বভোগীদের আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। এর মধ্য দিয়ে তারা আইনগতভাবে বৈধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে এবং তাদের দক্ষতা ও পেশাদারি বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই সঙ্গে অসাধু প্রতারক বা আদম ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। যাঁরা নেতিবাচক অর্থে ‘দালাল’ হিসেবে পরিচিত, তাঁরা আইনি স্বীকৃতি অর্জনের মধ্য দিয়ে ‘এজেন্ট’ পরিচয়ে মর্যাদাসম্পন্ন হবেন। তখন তাঁরাও হয়তো প্রতারকদের প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসবেন। একটি শক্তিশালী চক্র সবার চোখের সামনে বছরের পর বছর ধরে বিদেশে কর্মসংস্থান অন্বেষী মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল। তাদের কারণে বিদেশের অনেক সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে বাংলাদেশকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শ্রমবাজার নাটকীয়ভাবে সংকুচিত বা হাতছাড়াও হয়েছে। তাঁদের অবৈধ ও প্রতারণামূলক তৎপরতা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। সে কারণে জনশক্তি রপ্তানি ও অভিবাসন খাতে সার্বিক শৃঙ্খলা, নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা আশা করব, মধ্যস্বত্বভোগীদের আইনি কাঠামোতে আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।