
কক্সবাজারের চকরিয়ায় বাবার শ্রাদ্ধ শেষে ফেরার পথে বেপরোয়া গতির পিকআপের চাপায় পাঁচ ভাই নিহত হওয়ার ঘটনা আমাদের সড়ক পরিবহনের চরম বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থা ও নৈরাজ্যের বিষয়টি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। গত ৩০ জানুয়ারি মারা যান কক্সবাজারের চকরিয়ার সুরেশ চন্দ্র সুশীল। গত মঙ্গলবার ধর্মীয় আচার শেষে স্থানীয় একটি মন্দির থেকে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সুরেশ চন্দ্রের পাঁচ ছেলে। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলা অংশের মালুমঘাট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এর এক দিন পরই দুই স্কুলছাত্রীকে আরেকটি গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করে।
চকরিয়ায় গাড়ির নিচে পাঁচ ভাই নিহত হওয়ার তিন দিন পর পিকআপের চালক সাইফুল ইসলাম ঢাকায় গ্রেপ্তার হন। তাঁর কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা ভয়ংকর। এ গাড়ির কাগজপত্র ছিল না, চালক গাড়ি চালাচ্ছিলেন লাইসেন্স ছাড়া। সে ক্ষেত্রে একে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এটি ছিল ‘পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ড’। গাড়ির চালক, মালিক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এর দায় এড়াতে পারে না।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পিকআপটির মালিক চকরিয়ার জনৈক মাহমুদুল বিভিন্ন স্থানে সবজি সরবরাহ করতেন। কিন্তু ২০১৮ সালের পর এ গাড়ির নথিপত্র হালনাগাদ করেননি তিনি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব বলছে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ৪২২টি। আর বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য চালক লাইসেন্স আছে প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে একই লাইসেন্সে একজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল ও অন্য যানবাহন চালান। তাঁদের বাদ দিলে চালকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ। অর্থাৎ ১৮ লাখ যানবাহন ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে চলছে।
প্রশ্ন হলো ভুয়া লাইসেন্সে গাড়ি কীভাবে সড়কে নামে? লাইসেন্সবিহীন চালকই বা কীভাবে গাড়ি চালান? যানবাহন ও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ)। সড়কে আর কত মানুষ মারা গেলে সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিদের হুঁশ হবে? লাইসেন্স পেতে গাড়ির চালক ও মালিকদের মাসের পর মাস ধরনা দিতে হয়ে, হয়রানির শিকার হতে হয়। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মাঝেমধ্যে তাঁদের মৃদু ভর্ৎসনা করেন বটে। তাতে পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটেনি। বরং যতই দিন যাচ্ছে, সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে।
২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল। সেই আন্দোলনের মুখে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটিই কার্যকর হয়নি। এমনকি সড়ক পরিবহন আইনটিও হিমাগারে রাখা হয়েছে মালিক-শ্রমিকদের বিরোধিতার কারণে।
যে সন্তানেরা বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরছিলেন, তঁারাই লাশ হয়ে গেলেন। যে ছাত্রীদ্বয় স্কুলের কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিল, তাদেরও চাপা দিয়ে গেল চাঁদের গাড়ি। আমরা সড়কে আর একটিও দুর্ঘটনা ও মৃত্যু দেখতে চাই না। পাঁচ ভাই ও দুই স্কুলছাত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হোক। আমরা সরকারের কাছে এ নিশ্চয়তা চাই যে সড়কে আর কেউ হালনাগাদ বৈধ কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি সড়কে নামবে না এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কোনো চালক গাড়ি বের করতে পারবেন না।