তিস্তায় তাহলে পানি আছে, বাড়তি নেই?

তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে মাত্র সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় একই কথা বললেন। গত সোমবার, অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল কোচবিহারে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের বন্ধু। বাংলাদেশকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু তিস্তায় জল না থাকলে কী করব? উত্তরবঙ্গের চাষের কাজে জল দিয়ে বাড়তি জল থাকলে তা দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু রাজ্যকে বঞ্চিত করে জল দিতে পারব না।’ (সূত্র: প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল)।

একই রকম কথা তিনি বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময়ও (৭-১০ এপ্রিল)। তখন ‘তিস্তায় জল নেই’ (সূত্র: প্রথম আলো) বলেও তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছিল। এবার কোচবিহারে বলা তাঁর কথায় অবশ্য বোঝা যাচ্ছে যে তিস্তায় পানি আছে। তবে তার সবই পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহারেই লাগে। তাঁদের ব্যবহারের পর বাড়তি না থাকায় তিনি বাংলাদেশকে দিতে পারবেন না।

রাজনীতির ময়দানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে যথেষ্ট মাত্রায় বেপরোয়া প্রকৃতির, তা সবারই মোটামুটি জানা। কিন্তু সে জন্য তিনি যে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও আন্তর্জাতিক আইনকানুনের বিন্দুবিসর্গও না জেনে-শুনে রাজ্য চালাচ্ছেন, এ কথা তো বিশ্বাস করা যায় না। আবার এসব জেনে-শুনেও যে তিনি তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে একের পর এক লাগামহীন কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন, তাও তো অবিশ্বাস্য। সমস্যাটা এখানেই। এই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিস্তার পানি নিয়ে কী বলা যায়, সেটাই বিশেষ ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বোধ হয় অজানা নয় যে তিস্তা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি আন্তর্দেশীয় নদী। এ ধরনের নদীর পানিবণ্টন নিয়ে অববাহিকা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য ও বিরোধ নতুন নয়। সে কারণে এই বৈষম্য ও বিরোধ মিটাতে প্রণীত হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনকানুন। সেই আইনের মোদ্দা কথা হলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে পানি ভাগাভাগি করে নেওয়া।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোধ হয় এ কথাও অস্বীকার করবেন না যে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের হিস্যা শূন্য হতে পারে না। কাজেই কিছু না কিছু পানি বাংলাদেশ তো পাবেই। তিস্তার অববাহিকায় বাংলাদেশের যে জনগোষ্ঠীর বসবাস, চাষবাসে তাদেরও পানি প্রয়োজন এবং তিস্তার পানিতে তাদেরও পশ্চিমবঙ্গের জনগোষ্ঠীর মতোই সমান অধিকার। আবার তিনি যেভাবে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রয়োজন মিটানোর পর পানি অবশিষ্ট থাকলে তিনি বাংলাদেশকে দেবেন, এটাও কোনো নিয়ম-নীতি-ন্যায্যতা কিংবা আইনের কথা নয়।

এসব কথার পিঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো বলে বসবেন যে তাহলে বাংলাদেশ সেই আইনের আশ্রয়ই নিক। কিন্তু সেটা তো বন্ধুত্বের কথা হবে না। আপনি তো এ কথাও বলেছেন যে বাংলাদেশ আপনাদের বন্ধু। বাংলাদেশকে আপনারা ভালোবাসেন। বন্ধুর জন্য ভালোবাসার কথা তো এটা হতে পারে না। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন, আইনের আশ্রয় বাংলাদেশ নিতেই পারে। তাতে ফলও আপনার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের পক্ষেই আসবে। কিন্তু সেটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তত দিনে তিস্তায় অনেক পানি গড়িয়ে যাবে, যার ছিটেফোঁটাও বাংলাদেশকে না দেওয়ার একটি মোক্ষম অজুহাত আপনি পেয়ে যাবেন।

কোচবিহারেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তোর্সা, মানসই প্রভৃতি নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনায় বসতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন (প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল)। কিন্তু কথা হলো অভিন্ন নদীগুলোর কোনোটিই অন্য আরেকটির বিকল্প হতে পারে না। তোর্সা, মানসই দুই দেশের মধ্যেকার অভিন্ন নদী হলে সেগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হবে। বাংলাদেশ সব কটি অভিন্ন নদীর পানির অংশীদার। কাজেই তিস্তার অন্য কোনো বিকল্প দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। সর্বোপরি তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কারিগরি আলাপ-আলোচনা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এই পর্যায়ে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে বারবার বিভ্রান্তিকর কথা বলার উদ্দেশ্য কী?

আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানিবণ্টনকে একটি রাজনৈতিক ইস্যু করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। বিজেপির লক্ষ্য আগামী বছর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে সম্মত রয়েছে, সেটাও মমতার অজানা নয়। তাই তিনি তিস্তা চুক্তি বাধাগ্রস্ত করে পক্ষান্তরে বিজেপির বিরোধীতার মাধ্যমে তাঁর জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে চাইছেন।

অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকারও মমতাকে বাদ দিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে গড়িমসি করছে রাজনৈতিক কারণে। তারা ভাবছে, পশ্চিমবঙ্গে তাদের যে অগ্রযাত্রা, মমতাকে বাদ দিয়ে তিস্তা চুক্তি করলে, তা ব্যাহত হতে পারে। অন্তত মমতা বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরির সুযোগ নেবেন। মমতা তাদের ওপর সব দায় চাপিয়ে আমজনতার কাছে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চেষ্টা করবেন।

এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মমতার আরও কতিপয় বিষয়ে দর-কষাকষি আছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে রাজ্যের জন্য কেন্দ্রের অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তথা বাম জোটের দীর্ঘ শাসনের পর ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেন, কেন্দ্রের কাছে রাজ্য সরকারের প্রায় ১৫ হাজার কোটি রুপি ঋণ রয়েছে। তখন তিনি বলেছিলেন, বামপন্থী সরকারের অপচয়-দুর্নীতির কারণে এই ঋণ হয়েছে।

কিন্তু তার পরবর্তী মমতার শাসনামলে কেন্দ্রের কাছে সেই ঋণ তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। তাই এখন মমতা চাইছেন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের জন্য বরাদ্দ বাড়াক। সে জন্য যতভাবে চাপ দেওয়া সম্ভব, তিনি তা কেন্দ্রীয় সরকারকে দিচ্ছেন। তিস্তার পানিবণ্টনও এই চাপের অন্যতম। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারও এত সহজে মমতাকে ছাড়বে না।

বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এখন ভারতের এসব রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে ফেলা হয়েছে, যা বাংলাদেশের অবশ্যই হতাশার। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে সরকারের সর্বোচ্চ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

অরুণ কর্মকার, সাংবাদিক
arkrbd@gmail.com