সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

দিনে ৪০টি আত্মহত্যা

নীরব মৃত্যু রোধে সমন্বিত চেষ্টা চাই

নিত্যদিনের খবরের ভিড়ে আত্মহত্যার সংখ্যা এখন আর শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি এখন বাংলাদেশের জন্য এক গভীর সামাজিক সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশে দিনে গড়ে ৪০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছেন—আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেওয়া এই তথ্য কেবল উদ্বেগজনকই নয়; রাষ্ট্র, সমাজ ও নীতিনির্ধারকদের জন্য তা এক কঠিন প্রশ্নও তুলে ধরে।

যশোরসহ কয়েকটি জেলায় আত্মহত্যার হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি হওয়া আমাদের জানিয়ে দেয়, সমস্যাটি বিচ্ছিন্ন নয়; এটি কাঠামোগত, বহুমাত্রিক এবং দীর্ঘদিনের অবহেলার ফল। আত্মহত্যা মূলত একটি মানসিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের চূড়ান্ত প্রকাশ। কিন্তু বাংলাদেশে এই বিপর্যয়কে দীর্ঘদিন ধরে দেখা হয়েছে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা কিংবা নৈতিক দুর্বলতা হিসেবে। ফলে আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার আইনগত শাস্তি রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যার গভীরে না গিয়ে বরং তাকে আরও আড়াল করেছে। সম্মানহানি ও আইনি ভয় আত্মহত্যাচেষ্টার বহু ঘটনাকে অদৃশ্য করে রাখে। ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে রাষ্ট্রের কাছেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য পৌঁছায় না।

কারণগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, আত্মহত্যার পেছনে একক কোনো ব্যাখ্যা নেই। দারিদ্র্য, ঋণগ্রস্ততা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, দাম্পত্য সহিংসতা, কর্মহীনতা, পরীক্ষাভীতি, সামাজিক অপমান, মাদকাসক্তি এবং দীর্ঘস্থায়ী মানসিক রোগ—সবকিছু মিলেই এই সংকট তৈরি করছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির চাপ, ফসলহানির ভয় এবং সহজলভ্য কীটনাশক ও আগাছানাশক আত্মহত্যাকে আরও সহজ করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক গবেষণাও দেখায়, বিষাক্ত কৃষিজ রাসায়নিকের সহজপ্রাপ্যতা আত্মহত্যার হার বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো মানসিক স্বাস্থ্যসেবার চরম ঘাটতি। বাংলাদেশে প্রতি লাখ মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা অত্যন্ত কম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য এখনো প্রান্তিক বিষয়। সামাজিকভাবে মানসিক রোগকে ‘লজ্জার বিষয়’ হিসেবে দেখার প্রবণতা মানুষকে চিকিৎসার পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে অবসাদ, উদ্বেগ বা আত্মহত্যাপ্রবণতা সময়মতো শনাক্তই হয় না।

এই বাস্তবতায় আত্মহত্যা প্রতিরোধ কোনো একক মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানের কাজ হতে পারে না। স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি শিক্ষা, কৃষি, স্বরাষ্ট্র, সমাজকল্যাণ, তথ্য ও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, স্থানীয় পর্যায়ে কাউন্সেলিং সেবা বিস্তৃত করা এবং গণমাধ্যমে দায়িত্বশীল প্রতিবেদন নিশ্চিত করা জরুরি।

আইনগত সংস্কারও এখন সময়ের দাবি। আত্মহত্যাচেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বহু আগেই বলেছে, আত্মহত্যা একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা, অপরাধ নয়। আইন থেকে শাস্তির ভয় সরালে মানুষ সাহায্য চাইতে উৎসাহ পাবে, তথ্যের অন্ধকার ভাঙবে।

একই সঙ্গে কীটনাশক ও আগাছানাশকের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রাপ্যতা কমালে আত্মহত্যার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা আমাদের বলছে, সমস্যাকে আর উপেক্ষা করার সময় নেই। এখনই সমন্বিত, সাহসী ও মানবিক পদক্ষেপ না নিলে এই নীরব মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হবে।