সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো ও বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির কথা বলে আসছেন বহু বছর ধরে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স (সনদ) নবায়নে সরকার নির্ধারিত মাশুলের চেয়ে ছয় গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ দিতে হয় তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীদের। ঢাকায় যেকোনো ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে বাড়তি ৫ থেকে ৯ হাজার টাকা দিতে হয় বলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বয়লারের লাইসেন্স নবায়নে সরকার নির্ধারিত মাশুলের চেয়ে ৬৪৪ শতাংশ, শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বন্ডের লাইসেন্স নবায়নে ২৬১ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ হয়। এ ছাড়া ট্রেড লাইসেন্সে ১৬ শতাংশ, ফায়ার লাইসেন্সে ১১৪ এবং আমদানি ও রপ্তানি নিবন্ধন লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয় ব্যবসায়ীদের। ঢাকা সিটি করপোরেশনে যেকোনো ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতেও নির্ধারিত মাশুলের তুলনায় ৫ থেকে ৯ হাজার টাকা বেশি দিতে হয় বলে গবেষণায় এসেছে।
শতভাগ বড় কোম্পানি, ৬৮ শতাংশ মধ্যম আকারের কোম্পানি এবং ৬২ শতাংশ ছোট ও ক্ষুদ্র কোম্পানি দুর্নীতিকে প্রধান সমস্যা বলে মনে করে। ৫৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সরকারি কাজের চুক্তি ও লাইসেন্স নিতে ঘুষ দিতে হয়।
এর মানে ঘুষ ছাড়া সরকারি সেবা পাওয়া যায় না। কেবল ব্যবসায়ী নন, সাধারণ মানুষও এর ভুক্তভোগী। গাড়িচালকের লাইসেন্স থেকে জন্মনিবন্ধনের সনদ, কোনোটাই ঘুষ ছাড়া হয় না। হয়রানি বন্ধে ব্যবসায়ীরা ওয়ান–স্টপ সার্ভিস ও পাঁচ বছর পর লাইসেন্স নবায়নের কথা বলে আসছিলেন, কোনোটাই কার্যকর হয়নি। ওয়ান–স্টপ সার্ভিস বন্ধ হলে ঘাটে ঘাটে কর্মকর্তারা ঘুষ নিতে পারবেন না, এ কারণে এটি আটকে রাখা হয়েছে। লাইসেন্স নবায়নের বেলায় একই ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন করতে হলে প্রতিবছরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বাড়তি অর্থ আদায় করেন। পাঁচ বছর পর লাইসেন্স নবায়ন করতে হলে সেই সুযোগ থাকবে না।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রায় প্রতিদিনই নগরবাসীকে নসিহত করেন। কিন্তু যেসব কর্মকর্তা ব্যবসায়ী বা অন্য সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ নিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস তাঁর প্রতিষ্ঠানকে সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করেছেন। নির্ধারিত মাশুলের চেয়ে ৫ থেকে ৯ হাজার টাকা বেশি নেওয়া কি দুর্নীতিমুক্তের নমুনা? সনদ নবায়নে জড়িত সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলো ঘুষ–দুর্নীতিকে কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারে?
সিপিডির গবেষণা উত্থাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধে তিনি কী কী পদক্ষেপ নেন, আমরা সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি।
যেখানে দেশের ব্যবসায়ীরা নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছেন, সেখানে বিদেশিরা কেন বিনিয়োগ নিয়ে আসবেন? আসার জন্য যে পরিবেশ ও অবকাঠামো দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে জ্বালানির দাম বেড়েছে, সরবরাহে ঘাটতি আছে, তা–ও ব্যবসায়ীরা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু লাইসেন্স পেতে ও নবায়ন করতে পদে পদে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিতে হবে কেন?
সরকার যদি সত্যি সত্যি দেশে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে চায়, তাহলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। শুধু মুখে বললেই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয় না।