ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত দুই সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এটা স্পষ্ট যে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত কঠিন এক সময় পার করছে বাংলাদেশ। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাঁদের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও দাখিলের কাজ সম্পাদনে ব্যস্ত থাকলেও জনমনে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার বোধ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি কাটানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড, হত্যাকারীদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর, প্রথম আলো-ডেইলি স্টার-এ হামলা ও কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, ছায়ানট-উদীচীতে হামলা, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পুড়িয়ে হত্যা, শহীদ হাদি হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ—এসব ঘটনায় নাগরিকদের মধ্যে এই সংশয় ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে তো? আর যদি হয়, শেষ পর্যন্ত তা কেমন নির্বাচন হতে যাচ্ছে?
অবস্থাদৃষ্টে এখন এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে নির্বাচন আরও আগে অনুষ্ঠিত হলেই হয়তো ভালো হতো। সেটা যেহেতু হয়নি, তাই বর্তমান তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দেশের সব মহলকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন থাকতে হবে। এখানে কোনো অনিশ্চয়তার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর এই উপলব্ধিতে আসা জরুরি যে এই নির্বাচনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয় জড়িত রয়েছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে এবং তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে অন্তর্বর্তী সরকারের যে সক্রিয়তা ও কার্যকর ভূমিকা পালন করার কথা রয়েছে, সেখানে উদ্যোগ ও উদ্যমে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। ২৪ ডিসেম্বর মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময়কালে এটা সুস্পষ্টভাবে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা অবৈধ অস্ত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ছড়ানো, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ঢালাও জামিন, সীমান্তে নিরাপত্তার দুর্বলতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন। সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও ভয়হীন নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে প্রাথমিক এই চ্যালেঞ্জগুলো উতরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতেই হবে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সার্বিক আইনশৃঙ্খলার তদারকির মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু দুই সপ্তাহের বেশি সময় পার হওয়ার পরও ইসিকে সেই ভূমিকায় দেখা যায়নি। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিতে এবং নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে সংশয়, উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমরা আশা করি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। দেশে ফিরে তিনি বলেছেন, ‘শিশু হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক—যেকোনো বয়স, যেকোনো শ্রেণি, যেকোনো পেশা, যেকোনো বয়সের মানুষ নিরাপদে থাকুক—এই হোক আমাদের চাওয়া।’ বর্তমান বাস্তবতায় নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি দেশের মানুষের প্রধান উদ্বেগ।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। সেই অর্থে নির্বাচনবিরোধী দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। অন্তর্বর্তী সরকার ও সশস্ত্র বাহিনী—সব পক্ষই চায় ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আবারও গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হোক। এরপরও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও জনমনে প্রশ্ন তৈরি হওয়ার মতো পরিস্থিতি মোটেই কাম্য হতে পারে না। নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা, তা দূর করার সব উদ্যোগ তাই সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে।
স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও অগ্রগতি, নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক উত্তরণ যাত্রা—সব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সামনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচনের বিকল্প নেই। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন, সশস্ত্র বাহিনী, রাজনৈতিক দল—সবাইকে দেশের ও নাগরিকদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে দায়িত্বশীল হতে হবে।