সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

কূটনৈতিক সম্পর্কে উত্তেজনা

দিল্লিকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে

গত বেশ কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে উত্তেজনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত মঙ্গলবার একই দিন ঢাকা ও দিল্লিতে নিযুক্ত দুই দেশের হাইকমিশনারকে পাল্টাপাল্টি তলব করা হয়, এমন দৃষ্টান্ত এবারই প্রথম। এ ছাড়া ১২ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারত দুবার করে পরস্পরের কূটনীতিককে তলব করে নানা ইস্যুতে প্রতিবাদ ও উদ্বেগ জানায়।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতির সূচনাপর্বটি আমাদের জানা। বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থান ও স্বৈরাচার হাসিনার পতনকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত সরকার মেনে নিতে পারেনি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার যে ভারতের সমর্থনের কারণেই আওয়ামী লীগ সরকার এ দেশে দীর্ঘদিন স্বৈরশাসন জারি রাখতে পেরেছিল। তারা শেখ হাসিনার সব অপকর্ম এবং ভোটারবিহীন ও একতরফা নির্বাচনের বৈধতা দিয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রত্যাশী জনগণ ২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়। বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ভারত কার্যত বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে।

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার গত দেড় বছরে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার নানা উদ্যোগ নিলেও ভারতের তরফে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো চরম বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু করে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অনেক নেতিবাচক পদক্ষেপ যেমন ভারত নিয়েছে, তেমনি স্বাভাবিক ভিসা প্রক্রিয়া সংকুচিত করেছে।

সবচেয়ে বড় কথা, ভারতে আশ্রয় নিয়ে পদচ্যুত স্বৈরশাসক ও বর্তমানে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা নানা উসকানিমূলক কথাবার্তা ও কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও ভারত সরকার তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেনি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের নানা পর্যায়ের লোকজন ও সহস্রাধিক নেতা-কর্মী, যাঁরা ক্ষমতায় থাকার সময় হত্যা, গুম, খুন ও দুর্নীতির মতো অপকর্মে জড়িত ছিলেন, তাঁরাও ভারতে অবস্থান নিয়ে নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের জনগণের কাছে এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে ভারতের ভূখণ্ড বাংলাদেশবিরোধী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতের কূটনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা যে বিষয়গুলো জানেন না, এমনও নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখছি, ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো তাদের বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা জোরদার করেছে। প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত মঙ্গলবার দিল্লি, কলকাতা ও মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ মিশন অভিমুখে কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিক্ষোভ-সমাবেশ করে। এর আগে গত সোমবার শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের ভিসাকেন্দ্রে হামলা চালায় একদল উগ্রপন্থী। গত শনিবার রাতে দিল্লিতে সুরক্ষিত কূটনৈতিক এলাকায় ঢুকে উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশ হাইকমিশনের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। এ ধরনের সহিংস বিক্ষোভের কারণে বাংলাদেশকে দিল্লি, আগরতলা ও মুম্বাইয়ে ভিসা বন্ধ রাখতে হয়েছে।

ভারতের এসব ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের নাগরিকদের, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ বাড়ছে, যার প্রভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উত্তেজনা ও সহিংসতা বাড়ছে। সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডে প্রধান আসামিরা ভারতে পালিয়ে যান বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেন। খুনিদের ভারতে আশ্রয় পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। ময়মনসিংহে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসের মর্মান্তিক ও দুঃখজনক হত্যাকাণ্ডকে ভারতের উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলো নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সেখানকার জনরোষ উসকাতে ব্যবহার করেছে।

আমরা মনে করি, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের স্থিতিশীলতা দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থেই জরুরি। সে জন্য ভারতকে বাংলাদেশের বাস্তবতা ও রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা নির্বাচন কেমন ও কীভাবে করতে হবে, সে ব্যাপারে নাক গলানো ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা বা এ দেশের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজেদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় রাখার পুরোনো মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে।

আমরা আশা করি, ভারতের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ, উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। সহনশীলতা ও দায়িত্বশীল আচরণই পারে কূটনৈতিক উত্তেজনা প্রশমন করতে।