সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

পেশাদার অপরাধী ও শীর্ষ সন্ত্রাসী

অপরাধ দমনে অবশ্যই কঠোর হতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে পেশাদার অপরাধী যেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, তাতে নাগরিকদের সঙ্গে আমরাও যারপরনাই উদ্বিগ্ন। তুলে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, চুরি-ডাকাতি, ব্যবসায়ীদের হুমকি প্রদান ও চাঁদার জন্য প্রকাশ্যে কোপানোর মতো ঘটনা ঘটতে দেখেছি। ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ তো নগরবাসীর জন্য মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে উৎকণ্ঠার বিষয় হচ্ছে, খোদ পুলিশই বলছে, এসব অপরাধে পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার তথ্য তাঁরা পেয়েছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের একাধিক সূত্রে প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩২৯টি। রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় ছিনতাইপ্রবণ ২৭৯টি ‘স্পট’ চিহ্নিত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একাধিক বৈঠকে সম্প্রতি অপরাধগুলোর সঙ্গে পেশাদার সন্ত্রাসী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর একটা তালিকা প্রকাশ করে। দীর্ঘদিন আড়ালে থাকার পর তাঁদের অনেকে এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বের হয়ে আসেন। অপহরণ, চাঁদাবাজি, হুমকির মতো অপরাধের সঙ্গে তাঁরা জড়িয়ে পড়েছেন। রাজধানীর ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, কাফরুল, পল্লবী, বাড্ডা, মহাখালী ও মতিঝিল এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়েছে। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক মাসে অপরাধ বেড়েছে।

একসময় ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ তাঁদের অপরাধের কারণে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয় জনজীবনে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দীর্ঘ প্রচেষ্টায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে গ্রেপ্তার হন, অনেকে দেশের বাইরে চলে যান। ফলে শীর্ষ সন্ত্রাসীকেন্দ্রিক অপরাধ তৎপরতা অনেকটা কমে এসেছিল।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের জামিনে মুক্তির ঘটনা সামগ্রিকভাবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা কীভাবে মুক্তি পেলেন, সেটাই বড় প্রশ্ন। আবার মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা কোথা থেকে, কীভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন, সেটা বের করতে না পারাটা পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার জন্য বড় ব্যর্থতার বিষয়।

বিগত সরকারের সময় পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় দমন–পীড়নের কারণে পুলিশকে জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছিল। এ অবস্থায় যৌথ বাহিনী মাঠে নামে। পাঁচ মাস পরে এসেও সেই ধাক্কা পুলিশ এখনো সামলাতে পারেনি। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যেমন মনোবলের ঘাটতি আছে, একই সঙ্গে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও যানবাহনের অভাবে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ও অপরাধ দমনে পুলিশ পুরোপুরি সক্ষম না হয়ে ওঠার সুযোগই নিচ্ছে অপরাধীরা। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের সময় ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের বড় অংশ এখনো উদ্ধার করা যায়নি। নাগরিকের নিরাপত্তাবিধানের প্রশ্নে এটাও একটা বড় শঙ্কার কারণ।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এ মুহূর্তে নাগরিকদের সবচেয়ে বড় দুটি উদ্বেগের নাম। অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে পেশাদার অপরাধী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জড়িয়ে পড়ার মানে হচ্ছে, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হওয়া। এ ধরনের পরিবেশ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির সচলতার জন্যও স্বাভাবিক নয়। যেকোনো মূল্যেই পুলিশকে নিষ্ক্রিয় অবস্থান থেকে সক্রিয় হতে হবে। পেশাদার অপরাধী ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।