সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে স্থবিরতা

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটানো জরুরি

নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকাটাকে ইতিবাচক বলতেই হবে। বিগত সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের পাশাপাশি লুটপাট, দুর্নীতির কারণে অর্থনীতি যেভাবে খাদের কিনারে পৌঁছে গিয়েছিল, বিশ্বব্যাংকের ৪ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সেখানে কিছুটা স্বস্তিরই। আমরা মনে করি, সরকার যে সংস্কার উদ্যোগগুলো নিয়েছে, তার ফলে অর্থনীতি এমন দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছে। কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জগুলো এখনো বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ঘিরে রয়ে গেছে। বেসরকারি বিনিয়োগে শ্লথগতির পাশাপাশি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দারিদ্র্য বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনো সেটা আটের ওপরে থাকায় বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে, যেটা জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলছে।

গত মঙ্গলবার বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে খুব সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির এমন ভাটা। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য চার ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো বেসরকারি বিনিয়োগে শ্লথগতি, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক খাত ও রাজস্ব আদায়ে ক্রমাবনতি।

শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদেরাও নানা সময়ে সরকারকে অর্থনীতি ঠিক পথে পরিচালিত করতে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি না হলে এবং বিনিয়োগকৃত সম্পদের নিরাপত্তা না পেলে বিনিয়োগকারীরা কেন তাঁদের পকেটের টাকা বিনিয়োগ করবেন? ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর থেকে নাগরিকদের বড় উদ্বেগের একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ১৪ মাসেও পুলিশ তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারেনি। মব-সহিংসতা, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণের মতো অপরাধ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়লেও এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি সংস্কারের লক্ষ্যে শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। তারা যে প্রতিবেদন জমা দেয়, সেখানে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের সুপারিশ ছিল। এর মধ্যে অনেক সুপারিশই ছিল, যেটা সরকার নির্বাহী আদেশে দ্রুত শুরু করে দিতে পারত। কিন্তু সেসব সুপারিশের অনেকগুলো আলোর মুখ না দেখায় ব্যাংক খাত, রাজস্ব খাতসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সংস্কারে গতি পায়নি। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩-২৪ শতাংশের মধ্যেই আটকে রয়েছে, তারপরও অন্তর্বর্তী সরকার যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারত, তাহলে পরিস্থিতির আরও উত্তরণ হতে পারত।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, এক বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্য বেড়েছে। শ্রমশক্তিতে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের হারও কমেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ৩০ লাখ কর্মক্ষম নারী-পুরুষ শ্রমশক্তির বাইরে চলে গেছেন, তাঁদের ২৪ লাখই নারী। এ পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগজনকই। নারীর ক্ষমতায়নে যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো আবশ্যক, সেখানে এই উল্টোযাত্রা সমাজ প্রগতির পথে বড় বাধা তৈরি করতে পারে। দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, সেটা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন পিপিআরসির সাম্প্রতিক গবেষণাতেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

এটা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে জিডিপির এই প্রবৃদ্ধির কারণ হলো রপ্তানি বৃদ্ধি ও রেকর্ড প্রবাসী আয়। কিন্তু এ দুটি সূচকই গোটা অর্থনীতির চিত্র নয়। টেকসই প্রবৃদ্ধি ও ভালো কর্মসংস্থানের জন্য সাহসী সংস্কার জরুরি। সবার আগে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশ ফেরানো দরকার।