সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

পেনশনের টাকায় শিশুপার্ক

শিক্ষক নাসিরের উদ্যোগ প্রশংসনীয়

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কয়া গ্রামে দারুণ এক দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। গড়াই নদের কূল ঘেঁষে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নাসির উদ্দিন তাঁর ৩৩ শতাংশ জমির বসতভিটাকে ‘শিশুপার্কে’ পরিণত করেছেন। হেমন্তের মাঠে নৌকা, মেঘ বা কাশফুলে ছবি আঁকা থেকে শুরু করে পাঠাগারে বই পড়া, বিলুপ্তপ্রায় গাছ ও ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র সম্পর্কে জানা—সবকিছু মিলিয়ে এ উদ্যান শিশুদের মানস গঠনে দারুণ এক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

শহর বা গ্রাম সবখানেই শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের পরিসর সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা বিনোদন মানে এখন বোঝে মুঠোফোনের স্ক্রিন। আবার অর্থনির্ভর বা বাণিজ্যিক বিনোদনকেন্দ্রও গড়ে উঠেছে, যেগুলোতে সব পরিবার বা সব শিশুর পক্ষে যাওয়ার সামর্থ্য ও সুযোগ থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে কুমারখালীর গ্রামটির শিশুদের জন্য নাসির উদ্দিন তাঁর বাবা-মায়ের নামে গড়ে তুলেছেন ‘কুলছুম নেছা-জালাল গান্ধী শিশুপার্ক’। বিনা মূল্যে শিশুরা এখানে খেলে, বই পড়ে, প্রকৃতি–পরিবেশ সম্পর্কে জানে, আনন্দ কুড়ায়। এখানে পয়লা বৈশাখ, নবান্ন উৎসবসহ নানা পার্বণে নাসির উদ্দিন শিশু-কিশোরদের নিয়ে আনন্দ আয়োজন করেন। এ ছাড়া গাছে ফল পাকলে শিশুদের নিয়ে উৎসব হয় বাগানে। শিশুরা আনন্দ করে সে ফল খায়।

২০০৫ সালে পেনশনের টাকায় শুরু হওয়া এই উদ্যোগের সঙ্গে আছে অর্ধশত বছর ধরে সংগ্রহ করা ২০০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের বিশাল এক সম্ভারও। প্রতিটি গাছে নাম লেখা, যাতে শিশুরা পড়ে চিনতে পারে। আছে সেন, পাল ও ব্রিটিশ আমলের ঐতিহাসিক জিনিসের জাদুঘর ও সংবাদ সংগ্রহশালা। এই শিক্ষক তাঁর ব্যক্তিগত সঞ্চয়, আবেগ ও ৫০ বছরের নিরলস পরিশ্রম বিনিয়োগ করে প্রমাণ করেছেন যে সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও দায়বোধ। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে যা করেছেন, তা রাষ্ট্রের শিক্ষা ও সংস্কৃতি উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

শিশুদের জন্য স্বর্গরাজ্য গড়ার স্বপ্ন দেখা নাসির উদ্দিনের মতো আলোকিত মানুষ দেশের কল্যাণে যে অবদান রেখে যাচ্ছেন, তা অমূল্য। শিশুরা যেখানে প্রকৃতির পাঠ নিচ্ছে, শিল্প-সংস্কৃতির স্পর্শ পাচ্ছে এবং চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের পাঠ শিখছে, সেই স্থানটি কোনোভাবে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। নাসির উদ্দিনের এই উদ্যোগের প্রতি স্থানীয় প্রশাসনের নজর পড়েছে, যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে সরকারিভাবে তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

 এই শিশুপার্ক যেন কেবল একটি অনুপ্রেরণামূলক গল্প হয়ে না থাকে, বরং দেশের গ্রামে গ্রামে এমন শিশুস্বর্গ গড়ে উঠুক, সেটিই কাম্য।