সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

এবারও পাঠ্যবই–সংকট

শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতিটা অপূরণীয়

এবারও কেন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শিক্ষার্থীর হাতে বছরের শুরুর দিন সব পাঠ্যবই পৌঁছানো সম্ভব হবে না? আগের শিক্ষাবর্ষের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কী শিক্ষাটা নিতে পারল? নতুন বছর শুরু হতে মাত্র কদিন বাকি, অথচ মাধ্যমিক স্তরের ৪৪ শতাংশ বই এখন পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়নি। এর অর্থ, এ বছরও বিপুলসংখক শিক্ষার্থীর নতুন শ্রেণির শিক্ষাযাত্রা শুরু হবে কয়েকটি পাঠ্যবই ছাড়াই।

এনসিটিবির কর্মকর্তাদের বরাতে প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরের সব শ্রেণির পাঠ্যবই মাঠপর্যায়ে সরবরাহ করা হয়েছে। আশা করা যায়, বিদ্যালয়গুলো থেকে ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন পৌঁছে যাবে। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরের সব শ্রেণির পাঠ্যবই নিয়েই সংকট তৈরি হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ষষ্ঠ শ্রেণির ৬৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, সপ্তম শ্রেণির ৩৬ দশমিক ২৩ শতাংশ, অষ্টম শ্রেণির ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও নবম শ্রেণির ৭০ দশমিক ৭৪ শতাংশ বই সরবরাহ করা হয়েছে। এ পরিসংখ্যানই বলে দেয় যে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব পাঠ্যবই পৌঁছাতে এখনো অনেকটা পথ বাকি। সবচেয়ে করুণ অবস্থা দেখা যাচ্ছে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবই সরবরাহের ক্ষেত্রে। বাকি ৯৫ ভাগ বই কবে ছাপানো হবে, কবেই–বা সরবরাহ করা হবে?

এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, বছরের শুরুতেই সব শিক্ষার্থীর হাতে অন্তত দু–একটি করে বই পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ক্ষেত্রে সেটা যে সম্ভব হবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। তাঁরা নিজেরাই বলছেন, মাধ্যমিকের সব বই সব শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে গোটা জানুয়ারি মাসই লেগে যাবে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে সেটাও যে কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় ও প্রশ্ন থেকেই যায়।

শেষ হতে যাওয়া শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছাতে তিন মাস সময় লেগে যায়। এ নিয়ে সরকার ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর পাঠ্যবই পরিমার্জনের কারণে পাঠ্যবই ছাপাতে ও সরবরাহ করতে দেরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতির মুখে পড়েছিল। বিশেষ করে মফস্‌সল, গ্রাম ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়ে। এবার যাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য নভেম্বরের মধ্যেই পাঠ্যবই ছাপানো ও সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এবারও পাঠ্যবইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে শিক্ষার্থীদের। যদিও পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ কপি পাওয়া যাবে অনলাইনে, কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর অনলাইনে ডাউনলোড করে বই পড়ার সুযোগ নেই।

এনসিটিবি যে যুক্তিই দিক না কেন, বছরের প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই তুলে দিতে না পারাটা প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার বহিঃপ্রকাশ। মাধ্যমিকের বই সরবরাহ করতে যে দেরি হতে পারে, সেই আশঙ্কার খবর প্রথম আলোয় একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে, সম্পাদকীয়ও লেখা হয়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে বেরিয়ে দায় ও দায়িত্ব নিয়ে পাঠ্যবই ছাপানো ও সরবরাহে যে মনোযোগ দেওয়া হয়নি, বাস্তবে সেটা দেখাই যাচ্ছে। এক বছরের শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবই না পাওয়ায় তিন মাস হোক আর এক মাস, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যে অপূরণীয় ক্ষতি, সেই উপলব্ধি না হলে দেরিতে পাঠ্যবই সরবরাহের এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।

করোনা মহামারি এবং গত ১৬ মাসের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একটা প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন যে কতটা ক্ষতির মুখে ফেলেছে, এ বছরের এসএসসি ও উচ্চমাধ্যমিক ফল বিপর্যয়ই তার সবচেয়ে কাছের দৃষ্টান্ত। আগামী প্রজন্ম ও দেশের ভবিষ্যৎ স্বার্থেই শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার বিকল্প নেই।