সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

পদোন্নতিতে তদবিরবাজি

তাহলে এসএসবি রাখার যৌক্তিকতা কী

৯ আগস্ট প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, সাম্প্রতিক কালে ১০ জন সরকারি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য ৯ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ডিও লেটার বা আধা সরকারি পত্র দিয়েছেন।

তাঁদের ডিও লেটারে উপসচিবকে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব করার সুপারিশ করা হয়েছে। বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) পদোন্নতি দিয়ে থাকে।

অস্বীকার করা যাবে না যে এসব ডিও লেটার কম ক্ষেত্রেই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে দেওয়া হয়। বরং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের অনুরোধ ও তদবিরে দেওয়া হয়। প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান বলেছেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি ডিও লেটার দিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, বিষয়টি তাঁর জন্যও বিব্রতকর।

কোনো কোনো মন্ত্রী ডিও লেটারের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে যোগ্য ও সৎ বলে অভিহিত করেছেন। এর অর্থ কি তাঁরা যঁাদের নামে ডিও লেটার দেননি, তাঁরা সবাই অযোগ্য ও অসৎ?

আবার কোনো কোনো মন্ত্রী-সংসদ সদস্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে সক্রিয় সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পরিবারের সদস্য বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের এই দাবির যৌক্তিকতা কী। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী নন, তাঁরা পদোন্নতি পাবেন না। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পরিবার থেকে আসেননি, তঁাদেরও পদোন্নতির সম্ভাবনা নেই?

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী তাঁর পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে পারবেন না। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, যে কর্মকর্তার পক্ষ হয়ে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা পত্র দেন, সেই কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। কারণ, তিনিই পত্র পাঠানোর জন্য তদবির করেন।

ছাত্রজীবনে কে কোন সংগঠন করেছেন কিংবা কে কোন পরিবারের সদস্য, সেটি পদোন্নতির জন্য বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। আর যদি ডিও লেটার কিংবা সুপারিশই পদোন্নতির মাপকাঠি হয়ে থাকে, তাহলে এসএসবি রাখারই কী প্রয়োজন। সরকারি কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনও গুরুত্বহীন হয়ে যায়।

আমাদের জনপ্রশাসনে এমনিতেই বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। যেকোনো দেশের জনপ্রশাসন হয় পিরামিড আকৃতির। নিচের দিকে লোকবল অনেক বেশি থাকে, ওপরে কম। কিন্তু পাইকারি পদোন্নতি দেওয়ায় আমাদের প্রশাসন উল্টো পিরামিড আকৃতি নিতে চলেছে। পদ না থাকতেও অনেককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এতে প্রশাসনের দক্ষতা যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ডিও লেটারের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, ডিও লেটার বা আধা সরকারি সুপারিশ মানা বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, এতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও এসএসবির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। যেসব কর্মকর্তা দক্ষ, তাঁদের নিজ গুণেই পদোন্নতি পেয়ে যাওয়ার কথা। এ জন্য তাঁদের তদবির করতে হয় না। তদবির তাঁরাই করেন, যাঁদের যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি আছে।

আমরা আশা করব, সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি তাঁদের যোগ্যতা ও মেধার ওপর ভিত্তি করেই হবে। আর মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা ডিও লেটার দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।