সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

রেলওয়েতে পদোন্নতি

মন্ত্রী কি ডিও লেটার দিতে পারেন

মন্ত্রণালয়ের প্রধান হয়ে মন্ত্রী যদি তাঁর মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার পদোন্নতি কিংবা পদায়নের জন্য সুপারিশ করেন, তাতে তাঁর স্বজনপ্রীতিই ধরা পড়ে না; যোগ্য কর্মকর্তারাও তাঁদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন। সম্প্রতি রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামের একটি ডিও লেটার বা আধা সরকারি সুপারিশপত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, রেলওয়ের বর্তমান মহাপরিচালক ১১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন। নিয়মানুযায়ী, দ্বিতীয় গ্রেডে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে একজনকে মহাপরিচালক করার কথা। দ্বিতীয় গ্রেডে দুজন কর্মকর্তা থাকার পরও রেলমন্ত্রী পছন্দের কর্মকর্তা মনজুর-উল-আলম চৌধুরীকে প্রথমে চলতি দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। এর পাশাপাশি তিনি ওই কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য খোদ আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে। 

ডিও লেটার দিয়ে মন্ত্রীর পছন্দের কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশকে নজিরবিহীন বলছেন রেলের কর্মকর্তারা। এটা কেবল অনৈতিকই নয়, সরকারি চাকরিবিধির লঙ্ঘন। অতীতেও মন্ত্রীদের ডিও লেটার দেওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। সেসব দেওয়া হয়েছে অন্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো কর্মকর্তার বিষয়ে। এখানে মন্ত্রী নিজের মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে মহাপরিচালক হিসেবে পেতে চাইছেন। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রী রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী হবেন না বলে যে শপথ নিয়েছেন, তা-ও ভঙ্গ হয়েছে। মন্ত্রী পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশে বলেন, মনজুর-উল-আলমের শ্বশুর মরহুম আবু সোলায়মান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। তিনি (মনজুর-উল-আলম) সৈয়দপুরে ১৯৭১ সালের শহীদদের স্মরণে রেলের টাকা খরচ না করে স্মৃতিসৌধ স্থাপন করেছেন। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) বৈঠক ডেকে এই কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করেন রেলমন্ত্রী। 

কেউ মন্ত্রীর এলাকার মানুষ হলে কিংবা কারও শ্বশুর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করলেই তার জামাতা মহাপরিচালক হতে পারেন না। বাংলাদেশে রেলওয়ের মহাপরিচালক কিংবা অন্য যেকোনো পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতার মাপকাঠিতে হওয়া উচিত। অন্য কোনো বিবেচনায় নয়। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো মন্ত্রী এমন এক ব্যক্তির নামে ডিও লেটার দিয়েছেন, যাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০২০ সালের দিকে মো. হাসান মনসুর ও মনজুর-উল-আলম চৌধুরীসহ ছয় কর্মকর্তার পদোন্নতির প্রস্তাব রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। ওই সময় চারজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। হাসান মনসুর ও মনজুর-উল-আলম তৃতীয় গ্রেডে দুই বছর চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকায় পদোন্নতি পাননি। এ অভিজ্ঞতার শর্ত রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনের (রেহাই) জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়। কিন্তু হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে রেলের ২০টি ইঞ্জিন ক্রয়ে অনিয়ম ও মনজুর-উল-আলমের বিরুদ্ধে করোনাকালে সুরক্ষাসামগ্রী কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে প্রস্তাব ফেরত পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এর পর থেকেই তাঁদের পদোন্নতি আটকে আছে। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, মন্ত্রী পদে থেকে তাঁর অধীন এক কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য আরেকটি সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়ে তিনি সাধারণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে মন্ত্রী যে সাফাই গেয়েছেন, তা-ও অগ্রহণযোগ্য। তদন্ত কমিটি তাঁকে নির্দিষ্ট বিষয়ে দায়ী না করলেও আরও দায়িত্বশীল হতে বলেছে। এর অর্থ এই কর্মকর্তার পেশাগত কাজে দায়িত্বশীলতার ঘাটতি আছে। যাঁরা ইতিমধ্যে দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হয়েছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে তৃতীয় গ্রেডে থাকা কর্মকর্তাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে মহাপরিচালক পদে বসানো হলে নাজুক রেল যে নাজুকতর হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।