সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বিজয়পুরের মৃৎশিল্প

ঐতিহ্য রক্ষায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দরকার

কুমিল্লার বিজয়পুরের মৃৎশিল্প কেবল মাটির কারুকাজ নয়, এটি আমাদের শত বছরের পুরোনো এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। একসময় লাঙল-জোয়ালের গ্রামবাংলার সমার্থক এই মৃৎশিল্প আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায় আরও নান্দনিক ও রপ্তানিমুখী হয়ে উঠেছে। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ৯ বছর ধরে চলে আসা তীব্র গ্যাস-সংকট এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে খাদের কিনারে ঠেলে দিচ্ছে।

একসময় বিজয়পুরের সাতটি গ্রামের আট শতাধিক পরিবার এই পেশায় যুক্ত থাকলেও এখন তা কমে দেড় শতাধিক পরিবারে এসে ঠেকেছে। মাটির হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে বর্তমানে ফুলদানি, মগ, জগ ও টেরাকোটার মতো শোপিসগুলো জাপান, কানাডা, আমেরিকা ও আরব আমিরাতের মতো দেশেও সমাদৃত হচ্ছে। প্লাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়ামের প্রবল জোয়ারের বিপরীতে পরিবেশবান্ধব এই শিল্পের টিকে থাকা আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি–সংকটের কারণে উৎপাদনে ভাটা পড়ায় কারিগরেরা এখন ভাগ্য ফেরাতে পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে গ্যাস-সংযোগ পেলেও ২০১৫ সাল থেকে চাপ কমতে শুরু করে। বর্তমানে চাপ শূন্যের কোঠায় থাকায় খরচ সাপেক্ষে লাকড়ি দিয়ে মাটি পোড়াতে হচ্ছে, যাতে পণ্যের গুণগত মান ও ফিনিশিং নষ্ট হচ্ছে। বাখরাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষের ‘দেখছি কী করা যায়’—এমন চিরায়ত আশ্বাস এই প্রাচীন শিল্পের সংকট সমাধানে যথেষ্ট নয়। ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের প্রসারে যে দেশে বড় বড় নীতি প্রণয়ন হয়, সেখানে একটি সুপরিচিত ও রপ্তানিমুখী সমবায় সমিতির জ্বালানি সমস্যার ৯ বছরেও সমাধান না হওয়া সংশ্লিষ্টদের বড় ধরনের ব্যর্থতাই বলতে হবে।

অন্যদিকে কুমিল্লার রসমালাই ও খাদির মতো বিজয়পুরের মৃৎশিল্পও ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জিআই স্বীকৃতির প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও মাঠপর্যায়ে গ্যাস-সংকট নিরসন না হলে কেবল তকমা দিয়ে এই শিল্পকে বাঁচানো যাবে না।

প্লাস্টিক পণ্যের জোয়ারের মধ্যে পরিবেশের সুরক্ষার জন্যও মৃৎশিল্পের বাজার সম্প্রসারণ করা ও সে অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে বিজয়পুরের মৃৎশিল্পীদের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ সুগম করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট গ্যাস বিতরণ কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই শিল্পাঞ্চলে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ঐতিহ্য একবার হারিয়ে গেলে তা আর সহজে ফিরে পাওয়া যায় না। বিজয়পুরের চাকা যেন কারিগরের হাতের চাপে নয়, বরং রাষ্ট্রের সদিচ্ছার অভাবেই থেমে না যায়।