সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সিলেটের রুনা বেগম

নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত

দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ এবং মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর বাধা—এই তিন কঠোর বাস্তবতা ছিল রুনা বেগমের জীবনরেখা। যেখানে বেশির ভাগ নারী অভাবের কাছে হার মানেন, সেখানে সিলেট নগরের এই নারী উদ্যোক্তা প্রমাণ করেছেন, ব্যর্থতা বা প্রতিকূলতা জীবনের শেষ কথা নয়; বরং নতুন শুরুর প্রেরণা। তিনি শুধু নিজে সফল হননি, আরও কয়েক শ নারীকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। রুনা বেগমের সংগ্রাম ও সাফল্য বাংলাদেশের নারী সমাজের জন্য এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।

রুনা বেগমের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পে কোনো বিলাসী পরিকল্পনা ছিল না, ছিল চরম অভাবের তাড়না। টাইলসমিস্ত্রি স্বামীর অনিশ্চিত আয়ে যখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা, তখন শৈশবে মায়ের কাছে শেখা নকশিকাঁথা সেলাই তাঁকে আলোর পথ দেখায়। ৪৫০ টাকায় প্রথম কাঁথাটি বিক্রি হওয়ার ঘটনাটিই ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাসের প্রথম পুঁজি। এ ঘটনা থেকেই তিনি উপলব্ধি করেন, মেধা ও শ্রম দিয়ে ঘরে বসেই অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব।

তবে এই পথে হাঁটা সহজ ছিল না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন নারীর পণ্য নিয়ে হেঁটে দোকানে দোকানে যাওয়াকে ভালো চোখে নিতেন না পাড়া-প্রতিবেশীরা। কটূক্তি শুনতে হয়েছে, এমনকি স্কুটি চালিয়ে পণ্য সরবরাহ করার সময়ও সমালোচিত হতে হয়েছে। রুনা বেগম সেসব সমালোচনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁর এই দৃঢ়তা আজ পাড়া-প্রতিবেশীর বাঁকা চোখকে সম্মানে রূপান্তর করেছে।

রুনা বেগম কেবল নিজের অভাব দূর করেননি, প্রায় ৪০০ গ্রামীণ ও সুবিধাবঞ্চিত নারীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। এই নারীরা তাঁর নকশা করা কাঁথার কাজ ঘরে বসেই করেন, যা তাঁদের পরিবারের খরচ মেটাতে স্বামীর আয়ে সহযোগিতা করে। এ মডেলের মাধ্যমে আমরা দেখি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) কীভাবে স্থানীয় অর্থনীতির চালিকা শক্তি এবং নারী ক্ষমতায়নের মূল ভিত্তি হতে পারে। রুনা বেগমের নকশিকাঁথা এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো আন্তর্জাতিক বাজারেও যাচ্ছে। এ উদ্যোগ প্রমাণ করে, সঠিক নকশা, মানসম্মত পণ্য ও একাগ্রতা থাকলে দেশীয় হস্তশিল্প বৈশ্বিক বাজারেও নিজেদের স্থান করে নিতে পারে।

রুনা বেগম একজন সমাজসেবীও। তিনি রক্তদান এবং অসংখ্য নারীকে মোটরসাইকেল চালানো শিখিয়ে এক নতুন সামাজিক ভূমিকা পালন করছেন। রুনা বেগমের সাফল্য সরকারকেও একটি বার্তা দেয় : নকশিকাঁথার মতো ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও নারী উদ্যোক্তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং ঋণ–সুবিধা দেওয়া হলে তা বেকারত্ব দূরীকরণ ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রুনা বেগমের মতো আরও নারী উদ্যোক্তা দেশের অনেক এলাকায় আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের দৃষ্টান্ত আরও অনেক নারীর জন্য প্রেরণা হতে পারে।