সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

প্রশাসনেরও ঢুকতে ভয়

জঙ্গল সলিমপুর কি কোনো স্বশাসিত অঞ্চল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুর কি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সার্বভৌম কর্তৃত্বের বাইরের কোনো ‘স্বশাসিত অঞ্চল’? গত বুধবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘যেখানে প্রশাসনেরও ঢুকতে ভয়’ শিরোনামের প্রতিবেদন পড়লে যে কারোর মনে এই প্রশ্ন তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। বলা চলে, চট্টগ্রাম নগরীর মানচিত্রের অংশ এই অঞ্চলে চার দশকের বেশি সময় ধরে সমান্তরাল প্রশাসন চালু করেছে দখলদার ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। পাহাড় ও জঙ্গল ধ্বংস করে স্থাপন করা হয়েছে অবৈধ বসতি। সেখানে প্রবেশ করতে হলেও আলাদা পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়।

এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে জঙ্গল সলিমপুরের নিয়ন্ত্রণ যাঁরা করেন, তাঁদের এই ক্ষমতার উৎস কী? বিগত সময়ে যে সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছে, তাদের আশীর্বাদ নিয়েই দখলদার ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। সরকার পরিবর্তন হলে কেবল মুখই বদলেছে। এর কারণ হলো সরকারি জমি অবৈধভাবে বেচাকেনার বিশাল বাণিজ্য সেখানে গড়ে উঠেছে। এখানকার জমির পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ একর। বর্তমান বাজারমূল্যে এই জমির দাম প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। একদিকে গাছ উজাড় করে, পাহাড় কেটে সমতল জমি তৈরি করা হয়। অন্যদিকে সেটি প্লট আকারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে এসব জায়গা বিক্রি করা হয়। চার দশকে সেখানে কয়েক হাজার অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে। বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করার নামেও বাসিন্দাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়।

এই বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ও তার দখল টিকিয়ে রাখতে জঙ্গল সলিমপুরে সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এলাকা ঘিরে সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকে। প্রথম আলোর প্রতিবেদক জমি ক্রেতার ছদ্মবেশে সলিমপুরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রবেশপথে থাকা সশস্ত্র ব্যক্তিরা তঁাকে বাধা দেয় এবং সেখান থেকে ফিরে আসতে বাধ্য করে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের লোকজন অভিযান চালাতে গিয়ে অসংখ্যবার হামলার শিকার হয়েছেন।

পুলিশ ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা এমন একটি অঞ্চল ভয়ংকর রকম অপরাধপ্রবণ এলাকা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। সেখানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আগে থেকেই কয়েকটি গোষ্ঠী ছিল, যারা আওয়ামী লীগ নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যুবদলের একটি গ্রুপ সেখানে নতুন করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করে। ফলে সংঘাত ও হানাহানিতে গত ১৪ মাসে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন।

এটা ঠিক যে চার দশক ধরে জঙ্গল সলিমপুরে যে অরাজকতা ও আইনহীনতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে শিগগির বেরিয়ে আসার পথ নেই; কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যখন সমান্তরাল প্রশাসন চালু রাখে, তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে। আমরা আশা করি, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানকার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দ্রুত সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করা হবে।

জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড়খেকো ও ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে যাঁরা জমি কিনে অবৈধ বসতি গড়ে তুলেছেন, তাঁদের কীভাবে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া যাবে, তা নিয়েও একটি সমন্বিত পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। সেটি না করে উচ্ছেদ অভিযানে গেলে তাতে উল্টো ফল আসতে পারে।

আমরা মনে করি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে জঙ্গল সলিমপুরের পাহাড় ও জঙ্গলকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সামরিক-বেসামরিক, সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ৪৮টি প্রতিষ্ঠান জঙ্গল সলিমপুরে স্থাপনা নির্মাণের আবেদন করেছে। ফলে জঙ্গল সলিমপুর থেকে অবৈধ বসতি সরালেই সেখানকার পাহাড় ও বন রক্ষা করা হবে এমনটা নয়। কেননা, বাংলাদেশে পাহাড়, বন ও নদী দখল ও পরিবেশ ধ্বংসের দৌড়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। পরিবেশ ধ্বংসের এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।