সাতক্ষীরার শ্যামনগরে পানির সংকট আজ কেবল একটি অবকাঠামোগত সমস্যা নয়; এটি মানবজীবনের মৌলিক ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করে দেওয়া এক নীরব বিষণ্নতা। যেখানে জীবনধারণের প্রথম শর্ত (নিরাপদ পানির প্রাপ্তি) অনিশ্চিত, সেখানে শিক্ষা, স্বপ্ন কিংবা সম্ভাবনার কথা বলা একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। এ দেশে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা গচ্চা দেওয়া হয়। অথচ উপকূলে নাগরিকদের জীবনমানে স্বস্তি তৈরিতে পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা বা বিনিয়োগ নেই। এটি আমাদের নীতিনির্ধারকদের চরম ব্যর্থতা।
স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা, বিশেষত কিশোরীরা এই সংকটের সবচেয়ে নীরব ভুক্তভোগী। তাদের হাতে বই-খাতার বদলে পানির কলসি তুলে দিয়ে সমাজ যেন অজান্তেই ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে।
শ্যামনগরের বাস্তবতা নির্মমভাবে বৈপরীত্যপূর্ণ। চারদিকে নদী, খাল, জলাভূমি—তবু পান করার মতো এক ফোঁটা নিরাপদ পানি নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততার আগ্রাসন, অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের মিঠাপানির উৎস ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির এই প্রতিকূলতাই শেষ কথা নয়।
প্রকৃত সংকটটি তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা ও দীর্ঘদিনের অবহেলার মধ্য দিয়ে। এ কারণে পানির অভাব এখানে আর সাময়িক দুর্যোগ নয়, এটি একটি কাঠামোগত সংকটে পরিণত হয়েছে।
এই সংকটের সরাসরি অভিঘাত পড়ছে শিক্ষায়। যে বয়সে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের বেঞ্চে বসে মনন ও মনুষ্যত্ব গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেই বয়সেই তারা প্রতিদিন কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পথ হেঁটে পানির সন্ধানে বেরোতে বাধ্য হচ্ছে। পানি সংগ্রহের সময় নষ্ট হয়, ক্লাসে অনুপস্থিতি বাড়ে, পড়াশোনার ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়ে। শিক্ষা তখন আর অধিকার থাকে না; হয়ে ওঠে সুযোগসন্ধানী এক বিলাস, যা কেবল তুলনামূলক সচ্ছল পরিবারই বহন করতে পারে। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে পাঠক্রম থেকে ছিটকে পড়ে—নীরবে, বিনা ঘোষণায়।
এই বাস্তবতায় পরিবারকে দোষারোপ করা সহজ কিন্তু ন্যায়সংগত নয়। যে মা বলেন, ‘আজ স্কুলে যেয়ো না, পানি এনে দাও’, তিনি শিক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করছেন না; বরং রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে জীবন রক্ষার ন্যূনতম প্রয়োজন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটি কাঠামোগত ব্যর্থতার ফল।
নিরাপদ পানির দায়িত্ব যখন রাষ্ট্র বহন করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই ভার গিয়ে পড়ে পরিবারের ওপর; আর সেই ভার বহন করে সবচেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্যরা, অর্থাৎ নারী ও শিশু।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কিছু পানি প্রকল্প গড়ে উঠেছে। যেমন পিএসএফ, আরও প্ল্যান্ট, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা। কিন্তু এসব উদ্যোগ খণ্ডিত, অপ্রতুল এবং অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতি লিটার পানির মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া মানে কার্যত পানিকে পণ্যে পরিণত করা, যেখানে দরিদ্র পরিবারকে প্রতিদিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়—পানি না শিক্ষা, কলসি না খাতা। এই দ্বন্দ্ব কোনো সভ্য রাষ্ট্রে থাকা উচিত নয়।
এই সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন কেবল প্রকল্প নয়, প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। পানি ও শিক্ষা—এ দুই মৌলিক অধিকারকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। উপকূলীয় বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পানি ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যেখানে লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, খাস পুকুর পুনরুদ্ধার, চিংড়ি চাষের সীমারেখা নির্ধারণ এবং বিনা মূল্যে বা ভর্তুকিতে নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে স্কুলসংলগ্ন পানির ব্যবস্থা, মেয়েদের ওপর গৃহস্থালির কাজের চাপ কমাতে সামাজিক উদ্যোগ এবং শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সহায়ক কর্মসূচি নিতে হবে।
একটি সমাজকে তার ভবিষ্যৎ দিয়ে চেনা যায়। শ্যামনগরের শিক্ষার্থীরা যদি আজও পানির সন্ধানে স্কুলের পথ হারায়, তবে তা কেবল একটি অঞ্চলের নয়, সমগ্র রাষ্ট্রচিন্তার দৈন্য প্রকাশ করবে।