কর্মক্ষেত্রে পোশাক নিয়ে নির্দেশনা–বিতর্ক কিন্তু এবারই প্রথম নয়। এর আগেও ঘটেছে এ ধরনের ঘটনা। মনে পড়ে, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে একটি নোটিশ জারি করেছিলেন। ওই নোটিশে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, ইনস্টিটিউটের পুরুষদের টাকনুর ওপরে ও নারীদের হিজাবসহ টাকনুর নিচে কাপড় পরতে হবে। একই সঙ্গে পর্দা মেনে চলারও নির্দেশ দেওয়া হয়।
মুহূর্তেই সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে অবশেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে নোটিশটি প্রত্যাহার করা হয়। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছিলেন, রাষ্ট্রের কর্মচারীরা অফিসে কী ধরনের পোশাক পরে আসবেন, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে তাঁরা শালীন, মানানসই পোশাক পরবেন, সেটি বলা আছে। তিনি স্বীকার করেন, পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে এ ধরনের নোটিশ দেওয়া যথাযথ হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ কর্তৃক ব্যাংকের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোশাক–সংক্রান্ত সাম্প্রতিক নির্দেশনাটিও বেশ হইচই ফেলে সারা দেশে। নির্দেশনাটিতে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও ওড়না এবং অন্যান্য পেশাদার শালীন পোশাক পরার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ছোট হাতা ও ছোট দৈর্ঘ্যর পোশাক ও লেগিংস পরিহার করতে বলা হয়েছিল এবং ফরমাল স্যান্ডেল বা জুতা, সাদামাটা হেড স্কার্ফ বা হিজাব পরতে বলা হয়েছিল।
পুরুষদের পোশাকের ক্ষেত্রেও লম্বা বা হাফ হাতার ফরমাল শার্ট ও ফরমাল প্যান্ট পরতে বলা হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা ছিল জিনস ও গ্যাবার্ডিন প্যান্টে। বলা হয়েছিল, নির্দেশনা না মানলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা হবে। ২১ জুলাই থেকে নির্দেশনাটি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এবারও ব্যাপক সমালোচনার মুখে নির্দেশনাটি প্রত্যাহার করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র এ প্রসঙ্গে যেসব যুক্তি তুলে ধরেন, তা নিতান্তই অযৌক্তিক। তিনি পোশাকের সামঞ্জস্যতার মাধ্যমে বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। তাঁর কথা অনুযায়ী, পোশাকের সামঞ্জস্যতার মাধ্যমে যদি বৈষম্য দূর করা যেত, তবে তো দেশে কোনো বৈষম্যের ভিত্তিই রচিত হতো না। স্কুলে তো আমরা একই রকম পোশাক পরেই বড় হয়েছি। বৈষম্যের বীজ আমাদের মন থেকে উৎপাটিত হয়েছে কোথায়!
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মিডিয়ার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিষয়টি বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের গোচরীভূত হলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং তাঁর নির্দেশনা মোতাবেক বিষয়টি এ মুহূর্তে প্রত্যাহার করা হলো।’ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, নির্দেশনাটি ছিল পরামর্শমূলক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনায় পুরুষদের পোশাক কী হবে, সেটির উল্লেখ থাকলেও শুধু নারীর পোশাক নিয়ে কেন সমালোচনাটা তৈরি হলো, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বুঝি তাঁদের শ্রম দিয়ে নয়; বরং পোশাক দিয়ে তাঁদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের হাজারো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার গুরুত্ব না পেয়ে পোশাকের সংস্কারের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নির্দেশনাটিতে পোশাকের ক্ষেত্রে শালীন ও পেশাদার রঙের কথাও বলা হয়েছিল, যা ছিল রীতিমতো হাস্যকর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র এ প্রসঙ্গে যেসব যুক্তি তুলে ধরেন, তা নিতান্তই অযৌক্তিক। তিনি পোশাকের সামঞ্জস্যতার মাধ্যমে বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। তাঁর কথা অনুযায়ী, পোশাকের সামঞ্জস্যতার মাধ্যমে যদি বৈষম্য দূর করা যেত, তবে তো দেশে কোনো বৈষম্যের ভিত্তিই রচিত হতো না। স্কুলে তো আমরা একই রকম পোশাক পরেই বড় হয়েছি। বৈষম্যের বীজ আমাদের মন থেকে উৎপাটিত হয়েছে কোথায়!
ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী পোশাক নির্বাচন করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। সেখানে চাপিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। এ ধরনের নির্দেশনা নারী–পুরুষনির্বিশেষে যেকোনো মানুষের জন্যই অপমানজনক। তবে স্বীকার করতে হবে, পেশার ধরন অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পোশাকের প্রয়োজন নিশ্চিতভাবেই আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনটিতে নারীর পোশাক নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাড়তি দুশ্চিন্তা ছিল চোখে পড়ার মতো এবং এ ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারও আপত্তিজনক। বিশ্বজুড়েই কোন পোশাকটি নারীর জন্য শালীন আর কোনটি অশালীন, সে নিয়েও আছে বহু তর্ক–বিতর্ক। নির্দিষ্ট একটি সময়, পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিতে যা শালীন, অন্য পরিপ্রেক্ষিত বা পারিপার্শ্বিকতায় তা অশালীন বলে মনে হতে পারে। তাই ‘শালীনতা’ শব্দটি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক; যার নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই।
পৃথিবীতে সম্ভবত এমন একটি পোশাকও নেই, যা শতভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। তবে পুরুষের পোশাক নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক না থাকলেও নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক যেন থামতেই চায় না; হোক সে পোশাক আপাদমস্তক আবৃত, অনাবৃত কিংবা সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, নারীর পোশাকে বারবার আঘাত করার মধ্যে লুকিয়ে থাকে নারীর আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেওয়ার সেই সনাতন পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি, যা মনে করে নারীর আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দিলেই হয়তো থেমে যাবে নারীর অগ্রযাত্রা। নারীর পোশাক নিয়ন্ত্রণের করার মধ্যে লুকিয়ে আছে নারীকে অবদমিত রাখার কৌশল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় পুরুষদের পোশাকের ব্যাপারটিও যেহেতু অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাই কেউ কেউ বিষয়টিকে নারীদের জন্য বাড়াবাড়ি প্রতিবাদ বলে মনে করেছেন। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে যে বিশ্বজুড়ে পোশাকের রাজনীতিতে নারীরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পুরুষেরা সেভাবে হননি। তাই এই প্রতিবাদকে নারীদের পক্ষে অতিরঞ্জিত হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, একই রকম পোশাক পরিধান করলেই সমতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। সমতার বীজ বপন করতে হয় হৃদয়ের গভীরে, যাকে প্রতিদিন স্নেহ, যত্ন আর মমতায় অঙ্কুরিত করতে হয়, বড় করে তুলতে হয়। তবেই না সেই সমতার চারাগাছটি একসময় মহিরুহে পরিণত হয়। সারা দেশের পুলিশ বাহিনীও তো একই পোশাকে সজ্জিত হয়। কিন্তু সেই পোশাকেও সূক্ষ্মভাবে আছে উচ্চতর আর নিম্নতরের বিভাজন। এ দেশে বড় বড় স্বপ্ন আর সংকল্প নিয়ে পুলিশের উর্দিও বদলেছে বহুবার; কিন্তু বাহিনীটির চর্চার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি? তাই বলি, পোশাক নয়, বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
Purba_du@yahoo.com