
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ও এর পূর্বাপর নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
সরকার শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বল প্রয়োগ করে দমন করতে গেল কেন? এটা কি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যেত না?
হারুন–অর–রশিদ: আমি শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে যৌক্তিক বলে মনে করি। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা দেশে থাকা উচিত নয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একটি বিচক্ষণ রায় দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের দাবি প্রায় পুরোটাই তাতে পূরণ হয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলনের সুযোগে বিএনপি–জামায়াত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোয় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
সরকার কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করল না? শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার চার দফা জরুরি দাবি পেশ করেছেন। আগের আট দফা তো আছেই।
হারুন-অর-রশিদ: শিক্ষার্থীরা সরকারকে নির্দেশ দিতে পারেন না যে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দাবি মেনে নিতে হবে। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে। গত কয়েক দিন দেশে কী ভয়াবহ অবস্থা ছিল, সবাই তা দেখেছে। সরকারকে কেন সেনা মোতায়েন করতে কিংবা কারফিউ জারি করতে হলো, সেটাও আন্দোলনকারীদের বুঝতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। আমি মনে করি সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আন্দোলনকারী সবাইকে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে সরকারের কি উচিত নয় এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া? ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা?
হারুন-অর-রশিদ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পর্যায়ক্রমে খুলে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হলে যদি কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তার দায় কে নেবে? সবাই সহনশীল আচরণ করলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে। মনে রাখতে হবে, ছাত্রদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তারা আবারও সক্রিয় হতে পারে। ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে কোনো সমস্যা হলে সেটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবে, সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সেখানে ছাত্রলীগ–যুবলীগ মাঠে নামল কেন?
হারুন-অর-রশিদ: ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কিন্তু প্রথমে কোটা আন্দোলনের সমর্থক ছিল। কিন্তু যখন আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান দেওয়া হলো, তখনই তারা কর্মসূচি নিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো ছাত্রসংগঠনের পক্ষে তো এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তারা রাজু ভাস্কর্যের সামনে কর্মসূচি নিল। আর কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনারে সমাবেশ করল। দুই পক্ষের দুটি বড় কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিরোধী শক্তি তাদের স্বার্থ হাসিল করেছে। এর মধ্যে ছাত্রদল ও শিবিরের কর্মীরা ঢুকে গেছে।
কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে তো এই স্লোগানও উঠেছিল, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।’
হারুন-অর-রশিদ: কোটা সংস্কারের আন্দোলন তো ২০১৮ সালেও হয়েছিল। সরকার শিক্ষার্থীদের দাবিও মেনে নেয়। এবার হাইকোর্টের একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আবার শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। তবে সরকারও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে। এই সুযোগে সরকারবিরোধী বিএনপি–জামায়াত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তারা মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সেতু ভবনসহ অনেক স্থাপনায় হামলা করেছে, আগুন দিয়েছে। পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাদের সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ থামাতেই সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হয়েছে। ছাত্রসমাজের আন্দোলনকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। ছাত্রদের একটি অরাজনৈতিক আন্দোলনকে বিএনপি–জামায়াত সরকার উৎখাতের আন্দোলনে রূপ দিতে গিয়েই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ছাত্ররা বলেছেন, এসব ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা এর দায় নেবেন না।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রায় ২০০ প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। এটি কি এড়ানো যেত না?
হারুন-অর-রশিদ: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। দুই হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। এই মৃত্যু কোনোভাবে কাম্য ছিল না।
আমি মনে করি, এসব প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানো যেত, যদি বিএনপি-জামায়াত ঘোলা পানিতে মাছ শিকার না করত। এর আগে তারা বহুবার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, কিন্তু জনগণের সমর্থন পায়নি। এবার শিক্ষার্থীদের জনপ্রিয় আন্দোলনের ওপর ভর করেছে।
কিন্তু শুরুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তো ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করার পরই এটি সহিংস রূপ নেয়।
হারুন-অর-রশিদ: এ ক্ষেত্রে সব পক্ষেরই দায় ছিল।
সরকারের দাবি, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নাশকতা বা ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাননি। রাজনৈতিক অপশক্তি এসব করেছে। তাহলে অপশক্তি ঢোকার আগেই সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিল না কেন? মেনে নিলে তো এ পরিস্থিতি হতো না।
হারুন-অর-রশিদ: ছাত্রদের আন্দোলন যে এত ব্যাপক রূপ নেবে, সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন লাভ করবে, সেটা হয়তো সরকার উপলব্ধি করতে পারেনি। শুরুতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না। সরকারের পদক্ষেপে ঘাটতি ছিল। দূরদর্শিতার অভাব ছিল।
কোটা সংস্কারের ন্যায্য আন্দোলনে সবারই সমর্থন ছিল। এ সুযোগে বিরোধী দল সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে নিতে চেয়েছিল, সফল হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। আরেকটি বিষয় দেখুন। দেশের ভেতরে আন্দোলন ছিল। বিরোধী দল যদি সহিংসতা না করত, সম্পদ ধ্বংস না করত, এতগুলো প্রাণ ঝরত না। এর দায় তাদেরই নিতে হবে।
সরকার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
হারুন-অর-রশিদ: সরকার যদি নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তার করে, কিছু বলার নেই। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করলে সেটা নিন্দনীয়। কোনো নির্দোষ ব্যক্তি নির্যাতনের শিকার হোক, সেটা আমরা চাই না।
একজন সমন্বয়ককে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে পূর্বাচল এলাকায় ফেলে রেখে আসার অভিযোগ এসেছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আপনি ঘটনাটিকে কীভাবে দেখছেন?
হারুন-অর-রশিদ: এ রকম কিছু ঘটলে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উচিত আইনের আশ্রয় নেওয়া।
চলমান সংকট উত্তরণের উপায় কী? শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হচ্ছে না।
হারুন-অর-রশিদ: আমি বলব, সব মহলকেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া পূরণ হয়েছে। এখন তাদের আন্দোলন থেকে সরে আসা উচিত।
যেসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। সংযম ও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। মনে রাখতে হবে, কয়েক দিনের আন্দোলনে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। একে আর কোনোভাবে বাড়তে দেওয়া যায় না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
হারুন-অর-রশিদ: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।