ফিরোজ আহমেদ
ফিরোজ আহমেদ

বিশেষ সাক্ষাৎকার:ফিরোজ আহমেদ

দঙ্গলবাজি করে কেউ কেউ শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করছে

ফিরোজ আহমেদ লেখক ও চিন্তক; সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য–ব্যর্থতা, মব সহিংসতা, সংবিধান সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম

প্রশ্ন

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও রাজনীতির কী কী পরিবর্তন হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

ফিরোজ আহমেদ: অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যে কথাটা বলতেন, সেটাই আমি প্রশ্ন আকারে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব সম্পর্কে বলব: ইতিহাস তাঁকে রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিল, কতটা কাজে লাগাতে পারলেন তিনি?

অনেক বিবেচনায় শেখ মুজিবের চেয়েও অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। এত জনসমর্থন তাঁর আগে বাংলাদেশে কেউ পেয়েছেন কি না, জানা নেই। বাহাত্তর সালের বাংলাদেশকে আক্ষরিক অর্থেই তলাবিহীন একটা ঝুড়ি বলা যায়। হাসিনার আমলে দেশটাকে প্রায় দেউলিয়া বানানো হয়েছিল। এরপরও মাত্র কয়েক মাসে শুধু রেমিট্যান্সের টাকাতেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সামাল দেওয়া গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তো প্রায় শেষের পথে। দৃশ্যমান সাফল্য যদি কিছু বলতে হয়, সেটা মনে হয় আর্থিক খাতকে রক্ষা করা আর হাসিনার পতনের পর আন্তর্জাতিক চাপ থেকে দেশকে খানিকটা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে। এর বাইরে বড় কোনো সংস্কারের সামর্থ্য বা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি তাদের আছে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার কি কোনো উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পেরেছে?

ফিরোজ আহমেদ: এই বিষয়ে দুটি আলাদা উদাহরণ দিলে আশা করি বিষয়টা বোঝা যাবে। গণতান্ত্রিক রূপান্তর বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? একটা তো হলো অর্থনৈতিক দিক; রাষ্ট্রীয় সম্পদকে যেন জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চান, এমন যেকোনো পরিকল্পনাবিদ অবশ্যই বলবেন, দেশের রূপান্তর করতে হলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বহুগুণ বাড়াতে হবে এবং তা ব্যয় করতে হবে কার্যকরভাবে; কোনো অপচয় চলবে না।

গত ৫০ বছরে আমাদের পেছনে ফেলেছে, এমন সব দেশের দিকে তাকান। তারা বহুদিন পর্যন্ত শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ ভাগ কিংবা তারও বেশি ব্যয় করেছে। ভিয়েতনাম বলেন, কোরিয়া বলেন, চীন বলেন, মালয়েশিয়া বলেন—কোনো ব্যতিক্রম নেই। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত তারা এই ব্যয় করে শিক্ষাকে একটা বৈশ্বিক মানে এনেছে। তারপর তা হয়তো কোনো কোনো বছরে কমায়, তখনো তা চারের আশপাশে থাকে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এত বড় অভ্যুত্থানের পরও আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেক কম। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে দৃষ্টান্তমূলক একটা বরাদ্দ দিত, পরবর্তী সরকার কি সেটা কমাতে সাহস করত?

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা কী আশা করেছিলাম? এমন কিছু, যা সমাজের সম্পদের ওপর দখলদারত্বের যে প্রক্রিয়াটা চালু ছিল, সেটার বদল ঘটাবে। এটা ঘটলে ভোটে জিতে আসতে চাইলে পরের সরকারগুলো সেই বন্দোবস্তকে আর বদলানোর কথা কল্পনাও করত না। সরকার আমলাদের জন্য গাড়ি কিনবে নাকি শিক্ষকদের বেতন, প্রশিক্ষণ, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করবে—মানে সম্পদ কী কাজে লাগাবে, সেই ওয়াদা করতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্বর্তী সরকার বাধ্য করতে পারত নিজেরা সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কিন্তু অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই যদি পুরোনো রাস্তায় চলে, দলগুলোকে কী করে বাধ্য করবে?

প্রথম আলোতেই কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংকের সিটা প্রকল্প নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম। সফটওয়্যার খাতে বাংলাদেশকে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে। দেশের অগ্রগণ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সফটওয়্যার কেনার জন্য অবিশ্বাস্য বেশি দামে চুক্তি করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাগজপত্র যা হাতে পেলাম, একটা অংশে দেখলাম, ১০ ভাগের বেশি রাখা আছে বিদেশ সফরের জন্য। এটাই যদি পুরো প্রকল্পের চিত্র হয়, তাহলে ওই তিন হাজার কোটি টাকার মধ্যে হয়তো ৩০০ কোটি টাকাই ব্যয় হবে আমলা ও সংশ্লিষ্টদের বিদেশ সফরে। হয়তো বলছি, কারণ কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তিটা করা হয়নি, প্রায় গোপনে হয়েছে, হয়তো এই ব্যয় আরও বেশি।

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই কিন্তু এটা ঘটছে। আপনি সরকারের কাছে তথ্য চান, পাবেন না। আপনি বিশ্বব্যাংকের কাছে তথ্য চান, তারা সংগত কারণেই দেবে না। আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু বলছে যে বাংলাদেশে বিদেশি সফটওয়্যার কেনার চেয়ে দেশে তৈরি করাটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হয়েছে; দাম বিদেশিটার ১০ ভাগের ১ ভাগ। এই রকম অনেকগুলো উদাহরণ আছে। সবচেয়ে বড় কথা, এর মধ্য দিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিজ্ঞতা হয়, ব্যবস্থাপনার জ্ঞান বাড়ে, কর্মসংস্থান তৈরি হয়।

অন্যদিকে আপনি যদি এনবিআর বা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বা পরিসংখ্যান ব্যুরোর সফটওয়্যার বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে করেন, অভিজ্ঞতা বলে যে সেগুলো কাজে আসবে না, আসলেও তা হবে বহুগুণ বেশি দামের। তারও চেয়ে বড় কথা, এই রকম সব দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য-পরিসংখ্যানের মালিকানা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর হাতে চলে যেতে পারে। যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আশা ছিল, এই জবাবদিহিহীন প্রক্রিয়া বন্ধ করে একটা স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত পদ্ধতি চালু করবে, তারাই যদি সেটা চালিয়ে যায়, তাহলে তো বলা যায় পুরোনো বন্দোবস্তই রয়ে গেল; কেবল ওপরের দিকের কিছু মাথা সরেছে।
এ দুটি উদাহরণেই কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায়, সম্পদ বরাদ্দ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার দিক দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এমন কোনো কাজ করেনি, যার ফলে আমরা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হতে পারি।

প্রশ্ন

তাহলে গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমাদের অর্জন কী?

ফিরোজ আহমেদ: অন্তর্বর্তী সরকার বহুভাবে হতাশ করলেও এই সরকারই তো অভ্যুত্থানের সবটা নয়। গণ–অভ্যুত্থান নিজেই অন্তত তিনটা বড় সংস্কার করে ফেলেছে, সেইটাই জনগণের অর্জন। একটা বিষয় হলো গণ–অভ্যুত্থান দেশের পুরোনো বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক বানিয়ে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধকে গণতন্ত্রের মুখোমুখি বানানো, উন্নয়নকে গণতন্ত্রের মুখোমুখি বানানো, এই বুদ্ধিজীবীরা জনমানসে এখন আর প্রায় কোনো প্রভাব ফেলতে পারছেন না।

দ্বিতীয় অর্জনটা হলো, আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যে গুন্ডাতন্ত্র কায়েম করেছিল একটা রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি হিসেবে, সেটাকে এই গণ–অভ্যুত্থান উচ্ছেদ করেছে। এখনো রাজনৈতিক গুন্ডামি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি, কিন্তু যেকোনো ক্ষোভ–বিক্ষোভ দমনের জন্য পুরোনো পদ্ধতিগুলো, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম নামে নির্যাতন কেন্দ্র চালু করা যেকোনো দলের জন্য অনেক কঠিন হয়ে উঠবে। মুক্তির এই স্বাদ পাওয়া তরুণেরা সামনের দিনে অনেক নতুন নতুন ঘটনা ঘটাবে।

আর তৃতীয়ত, মানুষের আশা ও সাহস বেড়েছে। এইটা একটা বড় অর্জন। আপনারা দেখবেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারকে রীতিমতো ঘেরাও করে তাদের আবাসন ভাতা আদায় করেছে। উমামা ফাতেমার কাছে শুনেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা কীভাবে আন্দোলন করে তাদের জন্য এটা আদায় করেছে। ব্যক্তিগত আলাপে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি একদিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, এভাবে যদি রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আবাসন দাবি করতে থাকে, কীভাবে সম্ভব? অবাক হয়ে আমি বলেছিলাম, কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থ খরচে তো এটাই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা!

অর্থাৎ রাষ্ট্র আগের মতোই জনগণের জন্য টাকা খরচ করতে চাইছে না, কিন্তু শিক্ষার্থীদের সাহস বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে গুন্ডাতন্ত্র আওয়ামী আমলে ছিল, সেটাও উচ্ছেদ হয়েছে। জনগণকে বিভক্ত করে রাখা বুদ্ধিজীবীরাও গুরুত্ব হারিয়েছেন। এইটা একটা সুযোগ, মানুষের মধ্যে নতুন রাজনীতি, নতুন স্বপ্ন তৈরি করার। ইতিহাসের এই সময়গুলোতেই কিন্তু নতুন নতুন চিন্তা দানা বাঁধে।

ফলে একদিকে অনেক হতাশা যেমন আছে, আশাবাদের জায়গাও প্রচুর আছে। শিক্ষার্থীদের এই সাহসটাকে শ্রমিকদের মধ্যে, কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলেই দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র আসবে। আপনি আগের প্রশ্নে যে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কথা বললেন, আঠারো শতকের ইউরোপ বলেন আর আশির দশকের দক্ষিণ কোরিয়ার কথা বলেন, মানুষের সাহস বাড়ার পরিণামেই কিন্তু রাষ্ট্র নিজেকে রূপান্তর করতে, জনগণের মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগি করতে বাধ্য হয়েছে। এইটাই গণতন্ত্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি।

ফিরোজ আহমেদ
প্রশ্ন

বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন—এ প্রতিষ্ঠানগুলো কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে?

ফিরোজ আহমেদ: এ বিষয়ে সরাসরি উত্তর না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে বলি। মাও সে–তুং একবার চীনের বিচারব্যবস্থা নিয়ে বলেছিলেন, চীনের অধিকাংশ বিচারক দুর্নীতিপরায়ণ। কিন্তু যেখানে যেখানে কৃষক আন্দোলন শক্তিশালী, সেখানে সেখানে ন্যায্য বিচার পাওয়া যায়।

আক্ষরিক অর্থে নিলে কথাটা ঝামেলার মনে হতে পারে। কিন্তু কথাটার গভীর একটা দার্শনিক তাৎপর্য আছে। দুর্নীতি, অপচয়, বিচারহীনতা তখনই সম্ভব, যখন জনগণকে আপনি কর্তৃত্বহীন করে রাখতে পারেন, অস্বচ্ছ, জবাবদিহিহীন পদ্ধতিতে সব কাজ করতে পারেন। এ রকম শাসনব্যবস্থা যত দিন টিকে থাকবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও ভালো থাকার কোনো সুযোগ থাকে না।

কথার কথা হিসেবে বলা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশনে কিংবা বিচার বিভাগে কিছু যোগ্য এবং সৎ মানুষ থাকলেও আগে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কথা বললাম, সেখানে কোনো মৌলিক সংস্কার যদি না আসে, তাহলে ভালো একজন প্রধান বিচারপতি কিংবা যোগ্যতম দুদকপ্রধানও কিন্তু পুরোনো বন্দোবস্তকেই মেনে নিতে বাধ্য হবেন।

প্রশ্ন

রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রভাবে অর্থনীতি একটা অস্থির সময় পার করেছে। আপনি কি মনে করেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত এটা চলতেই থাকবে?

ফিরোজ আহমেদ: আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রেও অন্তর্বর্তী সরকারের দায় রয়েছে। অনেকেই বলছেন, অর্থনীতি যেভাবে চলছে, সেটা স্বাভাবিক; নির্বাচন হলেই অর্থনীতিতে গতি ফেরত আসবে। কিন্তু আমি জোর দিয়েই বলতে চাই, অর্থনীতিতে আগেই গতি ফেরানো সম্ভব ছিল এবং সেটা অনেক বড় একটা ত্বরণ তৈরি করতে পারত, যার ধাক্কায় নির্বাচন–পরবর্তী সময়েও আমরা অনেক দূর এগোতে পারতাম।
কেন এটা বলছি?  শুরুর দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, সেটাকে ব্যবহার করে তারা উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতাও তৈরি করতে পারত। কিন্তু সেটার জন্য তাদের এখতিয়ারে কী ছিল আর কী কাজ করলে তারা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে, সেই বিবেচনার অভাব দেখা গেছে প্রবলভাবে।

আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ নিয়ে বিরাট শোরগোল তুললেও অন্তর্বর্তী সরকার কি দেশের ব্যবসায়ীদের নিয়ে কোনো সম্মেলন করেছে? তাদের কথা শুনেছে? কোন প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হলে দেশে একটা শিল্পভিত্তি তৈরি হবে, বিনিয়োগের আসল প্রতিবন্ধকতাগুলো কী, সেটা চিহ্নিত করার এবং ভরসা তৈরি করার কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে?
চট্টগ্রাম বন্দরের উদাহরণটাই দেওয়া যাক। আমি বহু ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, এই বন্দরে তাঁদের সবচেয়ে বেশি দেরি হয় এনবিআরের আমলাতান্ত্রিকতার কারণে। বহু ব্যবসায়ী বন্দরে হয়রানি আর ঘুষের রাজত্বের কথা বলেছেন। আপনি যদি একমাত্র সমাধান হিসেবে চাপিয়ে দেন টার্মিনাল বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া—আপনার প্রজ্ঞা ও বাস্তববুদ্ধি নিয়েই তো প্রশ্ন আসবে। এ রকম বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর কার কার সঙ্গে সরকার কথা বলেছে?

এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও মতামত কেন রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? বিদেশি অপারেটরের হাতে গেলে ব্যবসার খরচ যদি বাড়ে, একই সঙ্গে এনবিআরের হয়রানিও যদি একই রকম থাকে, তাহলে তো বলতে হবে, সরকার সমস্যা দূর করার চেষ্টা করেনি; বরং সন্দেহজনক আচরণ করেছে।

দেশে যদি শিল্পোদ্যোক্তারা ভালো অনুকূল পরিবেশ পান, দুনিয়ার ব্যবসায়ীরা অংশীদার হিসেবে তাঁদের মাধ্যমেই এমনিতেই বিনিয়োগ করবেন, দীর্ঘ মেয়াদেই করবেন। কিন্তু যদি দেশের ব্যবসায়ীদের জিম্মি থাকতে হয় আমলা বা এনবিআর কর্তাদের কাছে, তখন বিদেশিরা আসবে কেবল সহজে দ্রুত মুনাফা তোলা যায়, এমন খাতগুলোতে; জ্বালানি, সফটওয়্যার বিক্রি এসব তখন হবে বিনিয়োগ। এ জন্যই সরকারের এত শোরগোলের পরও বলার মতো কোনো বিদেশি বিনিয়োগও আমরা শিল্প খাতে দেখিনি।

যে চাঁদাবাজির কথা শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন দলের কর্মী ও কথিত সমন্বয়কদের নামে, ব্যবসার পরিবেশ ও উদ্যোক্তাদের আস্থা ধ্বংস করার জন্য সেটাই তো যথেষ্ট। পত্রিকায় দেখলাম, বেছে বেছে ধনী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা–বাণিজ্য করার অভিযোগ এসেছে রাজশাহীতে, এটা তো গোটা দেশেরও পরিস্থিতি। এই পরিবেশে কে বিনিয়োগ করে দঙ্গলবাজদের নজর কাড়বে? এ কারণেই ব্যবসায়ীরা বসে আছেন নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে কারা ক্ষমতায় আসেন, সেটা দেখার জন্য।

অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি-হয়রানি-অস্বচ্ছতা-চাঁদাবাজি বন্ধ যে করেনি, তার ফলে তখনো হয়তো এই অরাজকতার ফাঁকফোকরেই উদ্যোক্তাদের টিকে থাকতে হবে। কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপ নিলে ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারতেন যে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পরের সরকারের একটা ধারাবাহিকতা বা পরম্পরা থাকবে। এই সরকার সেটা করতে সক্ষম হলে বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা ও কর্মসংস্থানে ভয়াবহ ঘাটতি থাকত না।

প্রশ্ন

গণ–অভ্যুত্থানের পর মব সহিংসতা কেন বেড়েছে। এটা কি আরও বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারে?

ফিরোজ আহমেদ: অন্তর্বর্তী সরকারের যত সাফল্যই থাকুক, ভবিষ্যতের ইতিহাসে পর্বটি দঙ্গলবাজির আমল হিসেবে চিহ্নিত হবে। বিষয়টাকে দুইভাবে দেখা দরকার। বাংলাদেশ আফগানিস্তান হবে বা এক দশক আগের সিরিয়া-ইরাক-লিবিয়ার মতো বিপর্যয় এখানে নেমে আসবে বলে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন। বহুদিন ধরেই বলছি, বাংলাদেশে তেমনটা হবে না। কারণ, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, সংস্থাগুলো শক্তিশালীভাবেই টিকে আছে। ওই দেশগুলোতো হয়তো সেগুলার অস্তিত্ব ছিল না, কিংবা যুদ্ধে একদম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ফলে সন্ত্রাস বা নৈরাজ্য এখানে হতে পারে; কিন্তু রাষ্ট্রের একদম পতন হওয়া কিংবা ছোট্ট কোনো গোষ্ঠীর আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করা এখানে সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে হাসিনার পুরো আমলে রাজনীতিকেই যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তার ফলে একটা রাজনৈতিক শূন্যতাও তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতার কারণে দঙ্গলবাজি করে কোনো কোনো নতুন দল, গোষ্ঠী, সংগঠন কিংবা ব্যক্তি নিজেকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। কোন কোন গোষ্ঠী দঙ্গলবাজির আতঙ্ক তৈরি করে চাঁদাবাজির ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। বহু জায়গায় মানুষ এত আতঙ্কিত এবং বিচ্ছিন্ন বোধ করছে যে তারা প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে ফেলেছে। বলা যায়, দঙ্গল জুলাইয়ের জনতার সংহতিকে ছত্রভঙ্গ করেছে।

দুনিয়াজুড়েই নানা পর্বে দঙ্গলবাজি ছিল। প্রতিবেশী ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দঙ্গল পাকানোকে বিজেপি নির্বাচনী কৌশল হিসেবে নিয়েছে এবং তারা একভাবে সফলও হয়েছে। বাংলাদেশে কোনো মৌলবাদী বা সাম্প্রদায়িক শক্তি এখন ক্ষমতায় নেই। অথচ সরকার মব সহিংসতা বা দঙ্গলবাজি বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এ থেকে বোঝা যায়, সরকারের মধ্যে খুবই প্রভাবশালী একটা অংশ আছে, যাদের কেউ কেউ এই দঙ্গলবাজদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। রাস্তায় ফকিরদের চুল-দাড়ি কামিয়ে দেওয়ার দৃশ্যগুলো অসুস্থ হয়ে যাওয়ার মতো; আমি জানি না, এরপরও উপদেষ্টারা কীভাবে রাতে ঘুমাতে পারেন?

সরকার যে চাইলে পারে, তার একটা সহজ প্রমাণ দেওয়া সম্ভব। মেয়েদের ফুটবল নিয়েও দঙ্গলবাজির চেষ্টা হয়েছিল; সরকার সেটা বন্ধ করেছে। এর কারণে দেশের ভেতরে সরকার কি বিরাট কোনো বিরোধিতার মুখে পড়েছে? আদৌ তা নয়। আমার ধারণা, নারীদের ফুটবল নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে হইচই হবে, সেটার কারণে সরকার এই বিষয়ে কঠোর ছিল। কিন্তু মাজারে হামলা বা ফকিরদের ওপর হামলাকে তারা সে রকম গুরুত্ব দিচ্ছে না; বরং তারা হামলাকারীদের তোয়াজ করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।  

দঙ্গলবাজি নিয়ে আরেকটা কথা বলতে চাই। দঙ্গলবাজির সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনের তফাতটা বোঝা খুব জরুরি। আপনি একটা দাবিতে সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, সেটা রাজনৈতিক আন্দোলন। কিন্তু আপনি যখন সমাজের দুর্বল কোনো অংশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের মদদে কিংবা নিস্পৃহতার সুযোগে যখন ঝঁপিয়ে পড়েন, সেটা দঙ্গলবাজি।

এই আমলে দঙ্গলবাজির সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিল ৩২ নম্বর ভেঙে ফেলার ঘটনা। বাড়িটা নিয়ে কী করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত সাহসের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই সাহস কিংবা প্রজ্ঞা না থাকায় তারা বলা যায় দঙ্গলের হাতে বাড়িটাকে ছেড়ে দেয়, নিজেরা দায়িত্ব এড়ায়। এভাবে দঙ্গলবাজিকে আশকারা দেওয়া আরও অজস্র দঙ্গলের পটভূমি তৈরি করে।  

ফিরোজ আহমেদ
প্রশ্ন

গণ–অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারত-পাকিস্তান-চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সক্ষম হয়েছে?

ফিরোজ আহমেদ: খুব সংক্ষেপে এই বিষয়ে যেটা বলতে পারি, ভারত ও পাকিস্তানের শাসকেরা এই অঞ্চলের সামষ্টিক যৌথ মঙ্গলের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের ওপর। মর্যাদা এবং সমতার ভিত্তিতে এই অঞ্চল পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কে থাকলে পৃথিবীর অন্যতম বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল হতে পারত এটা। সঙ্গে চীন-আফগানিস্তান-বার্মা যুক্ত হলে প্রত্যেকেই লাভবান হবে। কিন্তু বিজেপির কথা ধরুন, দলটা তো ভারতের মধ্যেই যে হিংসা ও বিভাজনের রাজনীতি করে, প্রতিবেশীর প্রতি সে সেটা আরও বহুগুণ বেশি করে। ওদিকে পাকিস্তান, দেশটার মালিক যেন সেনাবাহিনী! তারাও তাদের সংকীর্ণ স্বার্থেই দেশটাকে চালায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরো অঞ্চলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পক্ষে, কিন্তু তা অবশ্যই হতে হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে।

প্রশ্ন

আপনি সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ছিলেন। সংবিধান সংস্কার নিয়ে যদি কিছু বলেন।

ফিরোজ আহমেদ: রাষ্ট্রধর্ম বা অসাম্প্রদায়িকতার মতো কিছু গুরুতর প্রশ্নে কমিশনে আমরা একমত হতে পারিনি। ফলে সেগুলোতে ভিন্নমত জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কমিশনের সাফল্যের দিকটা হলো, বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোর সংকটগুলোকে কমিশন যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে। কমিশনের দেওয়া সব কটি সমাধানের সঙ্গে সবার একমত হওয়ার দরকার নেই, কিন্তু যে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনাকে প্রায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেগুলো এখন মানুষের আলাপে ফিরছে।

এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান যে প্রশ্নগুলোর মীমাংসা করতে পারেনি, তার জন্যই একাত্তরের প্রয়োজন হয়েছিল। উনসত্তরের আলোড়ন শুধু স্বপ্নটাকে মুক্ত করে দিয়েছিল। যে ফ্যাসিবাদী কাঠামোর অচলায়তনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো, সেগুলো যদি ক্ষমতাবানেরা এড়িয়ে যান, সামনের দিনে আমরা হয়তো আরও অনেক ছোট–বড় গণ–আন্দোলন, গণ–অভ্যুত্থানও দেখতে পাব।

প্রশ্ন

সংস্কার নিয়ে তো অনেক কথাবার্তা হলো। নির্বাচনের আগে কি আদৌ সংস্কার সম্ভব?

ফিরোজ আহমেদ: আমি যে সংস্কারগুলোর কথা বললাম, সেটা অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনার মধ্যে থাকলে তারা বিপুল জনসমর্থনের অধিকারী হতো; ব্যবসায়ী বলেন আর সাধারণ নাগরিক বলেন, প্রত্যেকেই ভরসা পেতেন যে ভালো একটা কিছু হতে যাচ্ছে। আমি নিজেই চাইতাম, তেমন একটা সরকার প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে সংস্কার করুক, দেশকে দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিকতা, অপচয় আর জবাবদিহিহীনতা থেকে মুক্ত করুক।

এখনকার পরিস্থিতির বিপদ হলো, অভ্যুত্থানের সরকার বলে সবাই এখন পর্যন্ত অস্বচ্ছতা–অদক্ষতার অভিযোগ সত্ত্বেও সরকারকে ছাড় দিচ্ছে। অন্যদিকে বিনিয়োগের অভাবে ব্যবসা–বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়ছে, জন–আস্থা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন দেওয়া এবং নির্বাচিত একটা সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে আমি আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকতেই যেন হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের চালানো হত্যাযজ্ঞ এবং তাঁদের দুর্নীতির বিচারের ক্ষেত্রে একটা যথাযথ অগ্রগতি নিশ্চিত করে।

প্রশ্ন

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ফিরোজ আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।