চিঠি
চিঠি

চিঠিপত্র

সোশ্যাল মিডিয়ার ভবিষ্যৎ: হাতের মুঠোয় বিশ্ব নাকি অদৃশ্য কারাগার

বর্তমান যুগে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনকে এমনভাবে ছুঁয়ে গেছে, যা কল্পনাতীত। সকালে চোখ খুলে প্রথম যা দেখি, তা হলো ফোনের স্ক্রিন। দিনে প্রথম কয়েক মিনিট ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার কিংবা টিকটক স্ক্রল করি, যা আমাদের নিত্যদিনের বদভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের সচেতনতা এতটাই ডিজিটাল হয়ে গেছে যে বাস্তব ও ভার্চ্যুয়াল জগতের সীমাও অস্পষ্ট। সোশ্যাল মিডিয়া শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি আমাদের জীবনধারা ও নিত্যদিনের চিন্তাচেতনার অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ শুধুই আলো দেখাবে নাকি আমাদের স্বাধীনতার জন্য অদৃশ্য কারাগারের মতো হয়ে উঠবে?

সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবৃত্তই এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেয়। কয়েক বছর আগেও ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম কেবল বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগের মাধ্যম ছিল। তখন মানুষ ছবি, ভিডিও বা ছোট বার্তা ভাগ করত। কিন্তু এখন তা হয়ে উঠেছে সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের এক শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। প্রযুক্তির উন্নতি এবং অ্যালগরিদমের প্রভাবশালী মিডিয়াকে আরও ‘বুদ্ধিমান’ করে তুলেছে। এটি আমাদের প্রতিদিনের ব্যক্তিত্বকে বিশ্লেষণ করে পছন্দ-অপছন্দ, আগ্রহ এবং সে অনুযায়ী কনটেন্ট দেখায়, যাকে এককথায় হাতের পুতুলও বলা যায়। ব্যবহারকারীদের জন্য সুবিধাজনক মনে হলেও, কখনো কখনো আমাদের মনোভাব ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।

ভবিষ্যতের সোশ্যাল মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) ব্যবহারের বৃদ্ধি। ভবিষ্যতে কনটেন্ট তৈরি, পোস্ট শিডিউল করা, এমনকি মানুষের আবেগ ও প্রতিক্রিয়ার হিসাব রাখার ক্ষেত্রে এআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একটি পোস্ট করে সর্বাধিক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারা, কোন ধরনের ছবি বা ভিডিও বেশি শেয়ার হবে এর সবকিছুই ভবিষ্যতে এআই দ্বারা নির্ধারিত হবে। এটি ব্যবসায়িক দিক থেকে অপরিসীম সুবিধা বয়ে আনবে, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে। আমরা কতটা স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত নিচ্ছি এবং অ্যালগরিদমে প্রভাবিত হচ্ছি, এটি বড় প্রশ্ন?

আরেকটি প্রবণতা হলো ভার্চ্যুয়াল ও অগমেন্ট রিয়ালিটির সংমিশ্রণ। সোশ্যাল মিডিয়ার ভবিষ্যৎ শুধু স্ক্রিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি বাস্তব জগতের সঙ্গে আরও গভীরভাবে সংযুক্ত হবে। যেমন আমরা ভবিষ্যতে ভার্চ্যুয়াল মিটিং, কনসার্ট বা প্রদর্শনীতে অংশ নিতে গেলে বাস্তব অভিজ্ঞতার অনুভব মনে হবে নিজেদের মধ্যে। তবে এটি মানবিক সংযোগের প্রকৃত মূল্যকে কীভাবে প্রবাহিত করবে, তা নিয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আসলে মানসিক সম্পর্ক হারিয়ে যাবে নাকি আরও সমৃদ্ধ হবে?

সোশ্যাল মিডিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা। আমাদের তথ্য আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশ্য। লোকেশন, পছন্দ-অপছন্দ, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া সবকিছু ডিজিটাল মাধ্যমে ট্র্যাক করা হচ্ছে। ২০২৫ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবহারকারী অনুভব করছেন যে তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সুরক্ষিত নয়। ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আরও উন্নত হবে এবং ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। সরকারের নিয়ম-নীতি, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির নীতি এবং ব্যবহারকারী সচেতনতা সবকিছু সম্বন্ধে অপরিহার্য। সোশ্যাল মিডিয়ার সামাজিক ও মানসিক প্রভাবও বিশাল।

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এটির অতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক চাপ, উদ্বেগ, একাকিত্ব ও আত্মসম্মানহীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। ভবিষ্যতে এর প্রভাব আরও গভীর হতে পারে, যদি ব্যবহারকারীরা সচেতন না হয়। সোশ্যাল মিডিয়া সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রবাহিত করতে পারে এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব বলতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়ার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ক্ষেত্র অসীম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য উদ্যোগ, ব্যবসা, সামাজিক সচেতনতা—সব ক্ষেত্রেই এটি বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুমে বসে একজন শিক্ষার্থী বিশ্বের যেকোনো শিক্ষক থেকে সরাসরি শেখার সুযোগ পাচ্ছে, দূর থেকে রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ এবং তথ্য ভাগ করে নেওয়ার মতো সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। জলবায়ু আন্দোলন, লিঙ্গ সমতা প্রচারণা বা স্থানীয় সেবামূলক কার্যক্রম মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবে সব সম্ভাবনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সতর্কতা।

সোশ্যাল মিডিয়া যদি সীমাহীনভাবে নিয়ন্ত্রণহীন থাকে, তাহলে এটি আমাদের স্বাধীনতার পরিবর্তে অদৃশ্য কারাগার তৈরি করতে পারে। অ্যালগরিদম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের পছন্দকে প্রভাবিত করলে আমরা কি সত্যিই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারব? আমাদের তথ্য যদি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হয়, তবে আমরা কি আসলেই আমাদের ‘ডিজিটাল স্বাধীনতা’ রক্ষা করতে পারব? এ প্রশ্নগুলো ভবিষ্যতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।

সোশ্যাল মিডিয়া ভবিষ্যতে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে থাকবে। এটি আমাদের যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসা ও বিনোদনকে নতুন মাত্রায় এগিয়ে নিয়ে যাবে। প্রযুক্তি কখনো শুধুই বন্ধুর মতো নয়, এটি শক্তিশালী, প্রভাবশালী এবং কখনো কখনো সীমাহীন। সতর্কতামূলক ব্যবহারই হবে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারের সম্ভাবনাকে নিরাপদ ও ফলপ্রসূ করার মূল চাবিকাঠি। হাতের মুঠোয় বিশ্ব বা অদৃশ্য কারাগার—ফলাফল নির্ভর করবে আমাদের বুদ্ধিমত্তা, নৈতিকতা ও সচেতনতার ওপর।

রিমি আক্তার

লোকপ্রশাসন বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়