প্রতিবছর ২৪ জুলাই সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা দিবস পালিত হয়। এটি একটি প্রতীকী দিন। বাংলাদেশেও আমরা ২৪ জুলাই দিনটি পালন করি। বাংলাদেশে বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবা বা কোম্পানিগুলোর আগমন ঘটে ১৯৮৮-১৯৯০ সালের মধ্যে, যখন প্রথম কয়েকটি কোম্পানি ছোট পরিসরে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য কোম্পানিগুলো ছিল সিকিউরেক্স, অতন্দ্র ও নিশ্চিত, শিল্ডস এবং আরও কিছু। সিকিউরেক্সের প্রতিষ্ঠাতা গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস (অব.) ছিলেন বাংলাদেশের বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবার অগ্রদূত বা জনক।
ব্যবসাটি গতি পেতে ও বিকশিত হতে সময় নিয়েছিল। তবে ১৯৯৪-৯৫ সালের মধ্যে আরও অনেক কোম্পানি, বিশেষ করে ঢাকায়, তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ভয়াবহ হামলার পর বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে নিরাপত্তা ব্যবসা এক বিশাল উল্লম্ফন লাভ করে। বিশেষ উগ্রবাদী ও চরমপন্থীদের হুমকিকে তখন সর্বোচ্চ উদ্বেগ ও ভীতির সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছিল।
সেই সময়ে বাংলাদেশে বৃহৎ পরিসরে কাজ করার জন্য প্রচুরসংখ্যক বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি জন্ম নেয়। ‘দারোয়ান’-এর পুরোনো ধারণা রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে যায়; উর্দি পরা নিরাপত্তাকর্মীরা কোম্পানির ব্যানারে সংগঠিত হতে শুরু করেন, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন উচ্চপদস্থ সাবেক সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁরা এই ব্যবসাকে একটি পেশাদার, সুসংগঠিত শিল্পে পরিণত করেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৬ সালে সরকার বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবা আইন-২০০৬ প্রণয়ন করে, যা শিল্পের জন্য একটি আশীর্বাদ হয়ে আসে। এই ‘আইন’-এর মাধ্যমে বেসরকারি নিরাপত্তা শিল্প দেশব্যাপী একটি অপরিহার্য পরিষেবা হিসেবে সুপরিচিত ও স্বীকৃত হয় এবং দেশের নিয়মিত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টায় পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।
আজ পর্যন্ত সারা দেশে ৮০০টিরও বেশি নিরাপত্তা কোম্পানি কাজ করছে। এই কোম্পানিগুলো ১২ লাখের বেশি কর্মীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। আমাদের গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে দূতাবাস, হাইকমিশন, জাতিসংঘের সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, সব ধরনের শিল্প, পোশাক, ফার্মাসিউটিক্যালস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস বা অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক এবং আরও অনেকে। বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিগুলো কী করছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের নগদ বহনকারী যানবাহনের মাধ্যমে স্থানান্তরিত বা পরিবহন করা হয়। দেশের ২০ হাজারের বেশি এটিএম অপারেশন বন্ধ হয়ে যাবে যদি নিরাপত্তা কোম্পানিগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
গত বছরগুলোয় বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিগুলো তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়েছে এবং বহুমুখী করেছে। এর মধ্যে রয়েছে তদন্ত পরিষেবা, নির্বাহী বা ঘনিষ্ঠ সুরক্ষা পরিষেবা, যথাযথ যাচাইকরণ, জরুরি উচ্ছেদ, সংকটপূর্ণ বা দূরবর্তী অঞ্চলের অপারেশন, ইভেন্ট নিরাপত্তা, বিরোধ নিষ্পত্তি; লজিস্টিক্যাল সহায়তা, ইলেকট্রনিক নিরাপত্তা, মেরিটাইম নিরাপত্তা, ডগ স্কোয়াড সহায়তা (কে–নাইন) এবং অন্যান্য বিবিধ পরিষেবা। আমরা বেশ কয়েকটি বিমা কোম্পানির জন্য মৃত্যুদাবি তদন্ত এবং চিকিৎসা/হাসপাতালে ভর্তির সনদও দিয়েছি।
বাংলাদেশে নিরাপত্তা কোম্পানিগুলোর আরও শক্তিশালী হওয়ার জন্য সরকারের কাছ থেকে অত্যন্ত সক্রিয় সাহায্য ও সহায়তা প্রয়োজন। আমাদের কর্মীদের ভালো প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো সংস্থান প্রায় নেই বললেই চলে। যেমনটি আপনি দেখেছেন, এ খাতে নিয়োজিত ১২ লাখের বেশি মানুষ নিয়মিত আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টায় পরিপূরক হিসেবে একটি দারুণ কাজ করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের অবদানের তেমন কোনো ভালো উপলব্ধি বা স্বীকৃতি নেই।
এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবার কিছু দুর্বলতা ও নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমরা বলতে চাই, দেশ, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জন্য বিশাল অবদান রাখা সত্ত্বেও বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবা সামাজিকভাবে এখনো খুব বেশি সম্মানিত নয়। এর প্রধান কারণ হলো এই পরিষেবার প্রতি আকর্ষণ কম বা নেই, কারণ বাংলাদেশে এটি সাধারণত একটি খুব কম বেতনের পেশা। গ্রামের একটি মেয়ে একজন নিরাপত্তা প্রহরীকে বিয়ে করতে বা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইবে না। কারণ, সে জানে, ‘ছেলেটি’ গরিব এবং সমাজের অন্যান্য উর্দিধারী পরিষেবার মতো তার কোনো ‘মর্যাদা’ নেই।
দেশে এমন বড় কোম্পানি, ব্যাংক কনগ্লোমারেট, বড় সিএসআর পারফরমার রয়েছে, যারা ৮ ঘণ্টার মাসিক কর্মসংস্থানের জন্য প্রতি গার্ডকে সর্বনিম্ন মজুরি বোর্ড (এমডব্লিউবি) অনুযায়ী ৮ হাজার টাকা প্রদান করে। এর অর্থ, একজন গার্ডের জন্য পুরো মাসের জন্য ৬০ মার্কিন ডলারের বেশি। এত কম পারিশ্রমিকে আপনি কীভাবে এই খাত থেকে ন্যূনতম ভালো পরিষেবা আশা করতে পারেন? এটি আসলে একটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। দুঃখজনকভাবে নিরাপত্তা কোম্পানি সমিতিগুলো খুব কার্যকর হতে পারেনি, বিজিএমইএ এবং দেশের অন্যান্য সমিতির মতো ভালো দর-কষাকষি করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো অগ্রগতি সাধন করার জন্য।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এই দরিদ্র নিরাপত্তাকর্মীদের অন্যান্য ‘ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা’র মতো অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ দেখা গেছে, কিন্তু তাঁদের জন্য কোনো ‘স্যালুট-তালি’ বা প্রণোদনা ছিল না। চিকিৎসক, আইনপ্রয়োগকারী, পোশাককর্মী এবং আরও অসংখ্য শ্রেণির কর্মীদের মতো নন, নিরাপত্তারক্ষীরা সত্যিই অবহেলিত রয়ে গেছেন। প্রণোদনার কথা আর কী বলব, আমরা আমাদের গার্ডদের পর্যাপ্তসংখ্যক পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদিও সরবরাহ করতে পারিনি। কারণ, এগুলোর ক্রমাগত বা বারবার ইস্যু করার খরচ বহন করা অসম্ভব। বিধিনিষেধ এবং গণপরিবহন না থাকায় এই গার্ডদের জীবন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল।
বর্ণনার শুরুতে ভালো দিকগুলো এবং শেষে নেতিবাচক দিকগুলো উল্লেখ করা সত্ত্বেও বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবা একটি ব্যবসা হিসেবে টিকে আছে। উন্নত বিশ্বে এটি একটি বড় ব্যবসা। রাজস্ব-লাভ, সব মিলিয়ে একটি যথেষ্ট বড় উদ্যোগ। অনেক কোম্পানি মিলিয়ন–বিলিয়ন ডলার আয় করে।
আশা করি, ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও পরিস্থিতি উন্নত হবে এবং আমরা তখন আরও ভালো অনুভব করব।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শরীফ আজিজ বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক