সোমবার (২৭ অক্টোবর) প্রথম আলো হাতে নিয়েই গাড়িতে উঠেছি। পত্রিকায় ছাপা হলেও তখনো খবরটি জানি না। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকর্মী অধ্যাপক মো. আমিনুল ইসলাম ভূইয়া জানালেন, রেজা ভাই, মানে বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী ও লেখক রেজাউর রহমান আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
রেজা ভাই এতটাই জীবন্ত ছিলেন যে ওনাকেও যে একদিন বিদায় জানাতে হবে ভাবিনি। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছিলেন, ‘মানুষ বাঁচতে চায়, এটিই প্রমাণ করে যে জীবনে সুখের মাত্রা এখনো বেশি।’ সেই দার্শনিক জায়গা থেকে রেজা ভাইকে দেখলেই মনে হতো, সুখান্বেষণের অপর নামই জীবন।
বলা যায়, রেজা ভাই একটি বাক্যও কখনো হিউমার ছাড়া বলতেন না। তাঁর রসবোধ এতটাই পরিশীলিত যে শুধু শুনতেই ইচ্ছা করত। ভদ্রতা, শালীনতা, আদবকায়দা, রুচিবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও হাজারো বিশেষণ দিয়ে বিধাতা রেজা ভাইকে সৃষ্টি করেছিলেন। সেই সঙ্গে চিরযৌবনও জুড়ে দিয়েছিলেন।
রেজা ভাই কখনো ‘বৃদ্ধ’ হননি। রেজা ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন অধ্যাপক আয়েশা খাতুন। আয়েশা আপা শিক্ষা ভবনের মহাপরিচালক হিসেবে অবসরে গিয়েছিলেন। তাঁরা দুজন একসঙ্গে কোনো আসরে বসলে কখনোই ক্লান্তি আসত না। আয়েশা আপা বলতেন, ‘কেউ বিশ্বাস করবে, রেজা আমার সহপাঠী?’
রেজা ভাই ও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। তিনি আমার সিনিয়র ছিলেন। প্রথম পরিচয়েই রেজা ভাই বন্ধু হয়ে গেলেন। তিনি তখন আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা শাখার দায়িত্বে।
রেজা ভাই, আপনার কি মনে আছে, আমার প্রবন্ধের শেষ বাক্যটিতে কি লিখেছিলাম? লিখেছিলাম, ‘জীবনানন্দের শঙ্খচিলের রূপসী বাংলা আরও অপরূপ হোক, আমাদের প্রকৃতি অনাদিকাল ধরে কবিতার উৎস হয়ে থাকুক, দেশের মানুষ প্রাণ খুলে হাসুক, পাখিরা নির্বিঘ্নে বিচরণ করুক আগামী শতাব্দীর শুভলগ্নে—এই হোক আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা।’
রেডিয়েশন বায়োলজি পড়ানোর জন্য খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে রেজা ভাই সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। শিক্ষার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো রেজা ভাইয়ের জটিল বিজ্ঞান সহজপাঠ হিসেবে পেয়ে ভীষণ খুশি। সময়টা সম্ভবত ১৯৯১ সাল।
হঠাৎ একদিন রেজা ভাই একজন অতি সুন্দরী নারীসহ আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন। দেখি, আমাদের হালিমা! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঘটনাটা কী?’ বললেন, ‘জি, উনিই আমার তিনি।’
হালিমা আমাদের ব্যাচের উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। আমরা একসঙ্গে প্রাণরসায়নে সাবসিডিয়ারি ক্লাস করতাম। হালিমা ভীষণ বিনয়ী, চুপচাপ ও মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। ব্যাচের আমরা সবাই ওর ভেতর একজন মহীয়সী নারী খুঁজে পেতাম। বিধাতা দুজন ভালো মানুষকে মিলিয়ে দিলেন।
রেজা ভাইয়ের ছোট ভাই মতি ভাইয়ের (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) সঙ্গে একদিনই আমার কয়েক ঘণ্টা কাটানোর সুযোগ হয়েছে। ওনার ভেতরেও রেজা ভাইকে খুঁজে পেয়েছি। মতি ভাই কাউকে পেলেই লিখতে বলতেন। আমাকে বললেন, ‘বাঘের ওপর একটা পাণ্ডুলিপি কবে হাতে পাওয়া যাবে?’ ওই ভয়ে মতি ভাইয়ের সঙ্গে আর কখনো দেখা করিনি। তাঁদের আরেক ছোট ভাই ডা. জাকিউর রহমানও বড় দুই ভাইয়েরই প্রতিরূপ।
রেজা ভাই প্রচুর লেখালেখি করতেন। বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর দুর্বলতা থাকলেও বহু বিচিত্র বিষয়েও লিখেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ, পদ্মা ও অন্যান্য প্রসঙ্গও বাদ পড়েনি।
বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালের মে মাসে শঙ্খচিল নামের পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশ পেল। আয়েশা আপা সম্পাদক, রেজা ভাই, খবির ভাই, ড. আনসারী ও আমি সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে কাজ করেছি।
আয়েশা আপা তখন হোম ইকোনমিকস কলেজের অধ্যক্ষ। ওনার ওখানেই প্রথম সভাটি হলো। তাঁদের দুই বন্ধুর আড্ডায় বিজ্ঞান ও জীবনের কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। সেদিন বিকেলে রেজা ভাই বললেন, যেহেতু আনোয়ার শঙ্খচিল নামটি প্রস্তাব করেছেন, তাই ওঁকে শঙ্খচিলের ওপর একটা লেখা দিতেই হবে। রেজা ভাইয়ের কথা রেখেছিলাম। লিখেছিলাম ‘শঙ্খচিলের বাংলাদেশ’ প্রবন্ধটি।
রেজা ভাই, আপনার কি মনে আছে, আমার প্রবন্ধের শেষ বাক্যটিতে কি লিখেছিলাম? লিখেছিলাম, ‘জীবনানন্দের শঙ্খচিলের রূপসী বাংলা আরও অপরূপ হোক, আমাদের প্রকৃতি অনাদিকাল ধরে কবিতার উৎস হয়ে থাকুক, দেশের মানুষ প্রাণ খুলে হাসুক, পাখিরা নির্বিঘ্নে বিচরণ করুক আগামী শতাব্দীর শুভলগ্নে—এই হোক আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা।’
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বেশি নৈকট্য দেখার আগ্রহ ছিল আপনার, রেজা ভাই। এ জন্য অনেক কাজও করেছেন। বিধাতা নিশ্চয়ই আপনাকে পুরস্কৃত করবেন, আমিন।
মো. আনোয়ারুল ইসলাম সাবেক অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।