
প্রথম আলো অমর একুশের বিশেষ সংখ্যায় বদরুদ্দীন উমরের মোটামুটি দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে। সেখানে তিনি ভাষা আন্দোলন, রাষ্ট্রের বিকাশসহ নানান বিষয়ে কথা বলেছেন। নতুন কিছু চিন্তা পাওয়ার আশা নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার পড়তে গেছি, কিন্তু হতাশ হয়েছি। ষাটের দশকে তাঁর লেখায় মার্ক্সবাদের যে ব্যাখ্যা আমরা পেতাম, এখনো তিনি সেই ঘেরাটোপে বুঁদ হয়ে আছেন। দেশে দেশে এখন বামপন্থীরাও মার্ক্সের যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দূর করার জন্য অন্য ডিসকোর্সও আনেন সামনে। কিন্তু তিনি অনড়, নিশ্চল। সাম্প্রদায়িকতা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শ্রেণিদ্বন্দ্ব বিকাশের ঘাটতি নিয়ে তাঁর বৈচিত্র্যহীন ব্যাখ্যা সই খাড়া বড়ি থোড়, থোড় বড়ি খাড়া। ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শ্রেণিদ্বন্দ্বের বিকাশ যে এখন পর্যন্ত হলো না, এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আওযামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করল। তার শ্রেণিচরিত্র উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ব্রিটিশ আমলের দ্বন্দ্বের মূলে ছিল এর দুটো উৎপাদক শ্রেণির মধ্যে গন্ডগোল। পাকিস্তান আমলেও তা-ই। বাংলাদেশ আমলে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ ছিল সম্পূর্ণভাবে মধ্যস্বত্বভোগী বা অনুৎপাদক শ্রেণি। এর নেতারা ছিলেন উকিল, মোক্তার, চিকিৎসক, স্কুলশিক্ষক, ছাত্রনেতা, বেকার। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাঁদের নেতা। তিনি মানুষকে জড়ো করতে পারতেন, আলোড়িত করতে পারতেন। এগুলোকে অবলম্বন করে তিনি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ক্ষমতায় এলেন। এই অনুৎপাদক শ্রেণি ক্ষমতা দখলের পর যে ধনসম্পদ অর্জন করল, তা তো উৎপাদনের মাধ্যমে করছিল না। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এরপর তৈরি হলো, সেটা তো লুণ্ঠনজীবী শ্রেণি, কোনো উৎপাদক শ্রেণি নয়। উৎপাদক শ্রেণি শোষক হলেও লুণ্ঠনজীবীদের চেয়ে ভালো। কারণ, তারা কাজের সুযোগ তৈরি করে। মানুষ কাজ পায়। এর মধ্যে পড়ে যে নতুন প্রজন্ম তৈরি হলো, সে কোথায় যাবে। সে জালের মধ্যে পড়ে গেল। লুণ্ঠনজীবীরা তো পাচ্ছে, তারা প্রতিরোধ করবে কেন? কাজেই প্রতিরোধ আন্দোলন হওয়ার মতো কোনো বা তেমন পরিস্থিতি এখন নেই।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি, তা হলো, উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় তথা ভারতবর্ষে রেনেসাঁর যে উদ্ভব হয়, সেটিও কিন্তু সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের দেহে একই রেনেসাঁর রক্ত প্রবাহিত। দুই দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রেনেসাঁর ফসল। কিন্তু রেনেসাঁ সৃষ্টিকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির এ আন্দোলনে কোনো দায় বা দায়িত্বই নেয়নি। ফলে, কোনো ঝুঁকিরও ছিল না। সবচেয়ে মজার তথ্য হলো, বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিও চাইতেন—শিক্ষার সব স্তরে যেন পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান পড়ানো হয়। শুধু রবীন্দ্রনাথ প্রথম ১৯০১ সালে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের পক্ষে আওয়াজ তোলেন। এ রকম মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিয়েও ভারতে শ্রেণিদ্বন্দ্বের বিকাশ তো হতেই থাকছে। বাংলাদেশের অবস্থার বিষয়ে পরে আসছি।
অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন ভারতের শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও ভারতীয় রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র নিয়ে। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, ভারতের এ শ্রেণিদ্বন্দ্ব প্রচলিত শ্রেণিসংগ্রামের বাঁধা ছকে ফেলে বিচার করা যাবে না। নির্দিষ্ট অবস্থার নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ এবং সেটা করতে গিয়ে নিজস্ব ‘ডিসকোর্স’ উদ্ভাবনের কথা মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকেরা বহুদিন আগ থেকেই বলা শুরু করেছেন। ভারতের শ্রেণিদ্বন্দ্ব ইউরোপের মতো শিল্পমালিক-শ্রমিক দিয়ে বুঝলে হবে না। ভারতে উচ্চবর্ণের হিন্দুরাই শিল্প-সংস্কৃতি-অর্থনীতির ধারক-বাহক। অন্যদিকে, দলিত বা নিম্নবর্ণের হিন্দুরা শোষিত উচ্চবর্ণ দ্বারা। আর ভারতের রাষ্ট্রের চরিত্র যদি বলি, সেখানে বুর্জোয়া মানে পুঁজির মালিক-উচ্চবর্ণবাদীরাই শাসক। তবে যাঁরা মার্ক্সবাদ চর্চা করেন, তাঁরা জানেন, রাষ্ট্র হলো সমাজবিকাশের নির্দিষ্ট একটা ঐতিহাসিক স্তরের আবশ্যিক ও নিয়মশাসিত পরিণাম। একটি রাষ্ট্রে উৎপাদন সম্পর্ক যখন পরিপক্ব হয়, তখন ফেটে যায় এবং শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ভারত রাষ্ট্রের উৎপাদন সম্পর্ক সেই পরিপক্বতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্র বা পরিপক্ব রাষ্ট্র নির্ধারণের মাপকাঠি যত না নির্ভর করে এখন সরকার, আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, কারাগারের ওপর, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভর করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণযোগাযোগমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রভৃতির ওপর। সমাজে শ্রেণিদ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে এবং পরিপক্ব হচ্ছে—এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ সামনে আনা যাবে। চাক্ষুষ দু–একটি উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।
ভারতের কৃষকদের ঐক্যবদ্ধতা এবং সদ্য সফল আন্দোলন বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁদের শক্তিমত্তা। ভারতের শোষিত শ্রেণি মানে দলিত সম্প্রদায়ের বড় ও লড়াকু রাজনৈতিক দল আছে এবং দলগুলো নির্বাচনেও ভালো করছে। দলিত সম্প্রদায় রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর অবস্থানও তৈরি হয়েছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে না আছে কমিউনিস্ট পার্টির দৃঢ় অবস্থান, না আছে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক-কৃষক। ভারত বিষয়ে এত বাক্যালাপ করার কারণ হচ্ছে একই রেনেসাঁর আলোকে আলোকিত দুটি দেশ। কিন্তু দেশ দুটির বিকাশে এত পার্থক্য কেন? এ প্রশ্নের উত্তর বদরুদ্দীন উমরসহ দেশের বামপন্থীরা কেউ খোঁজেননি। বরং এসব বিষয়ে বরাবরই তিনি নীরব থেকেছেন। বদরুদ্দীন উমর মার্ক্সবাদের সেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যাতেই নিজেকে বন্দী রেখেছেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার রেনেসাঁর সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেন না। রেনেসাঁর ফলাফলের দুটি দেশের তুলনামূলক আলোচনা ও বিকাশের রকমফেরের কারণের বিষয়ে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতাকে মার্ক্সের শোষক-শোষিতের কাঠামোয় ফেলে ব্যাখ্যা করেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রগতিশীল আন্দোলনের সম্পৃক্ত না হওয়াকে তিনি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীনতাকে দায়ী করেন। তবে সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, প্রাতিষ্ঠানিক মার্ক্সবাদী হিসেবে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক ঘটনার রাজনৈতিক ও অর্থনীতির দিক তিনি বারবারই তুলে ধরেন। কিন্তু প্রতিটি ধর্মের সৃষ্টি, বিকাশ এবং কনটেন্টের যে রাজনৈতিক অর্থনীতির ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে, তা তিনি বেমালুম ভুলে যান। এতে তাঁর লেখা একপেশে এবং কখনো কখনো খানিকটা সাম্প্রদায়িকও মনে হয় বটে।
এবার আসি বাংলাদেশের প্রসঙ্গে। এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রগতিশীল আন্দোলনের ব্যর্থতার একমাত্র কারণ বদরুদ্দীন উমর চিহ্নিত করেন উৎপাদকহীন শ্রেণির লুণ্ঠনজীবিতাকে। তাঁর ব্যাখ্যাকে মেনে নিলেও তো সম্পূরক প্রশ্ন আসে, এ লুণ্ঠনজীবিতাকে প্রতিহত করতে পাল্টা প্রতিরোধী শ্রেণি গড়ে উঠছে না কেন? প্রতিরোধী শ্রেণি গড়ে ওঠার বাধাগুলো কী? বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর যে আত্মপরিচয় ৫০ বছরেরও মীমাংসা হয়নি; আত্মপরিচয়ে সে আগে মুসলিম না বাঙালিকে রাখবে, নাকি দুটিই সমভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে জনসাধারণের সিদ্ধান্তহীনতা রয়েছে। অমীমাংসা রয়েছে রাষ্ট্রের চেহারা কেমন হবে তা নিয়ে—এটা কি ধর্মীয় হবে, না সেক্যুলার? এসব বিষয়ের যে সুরাহা প্রয়োজন, তা বদরুদ্দীন উমর একদম ধর্তব্যের ভেতরেই রাখেন না।
ধরে নিলাম রাতারাতি আমরা লুণ্ঠনজীবিতাকে প্রতিহত করলাম, কিন্তু আত্মপরিচয় ও রাষ্ট্রবিষয়ক প্রশ্নের কোনো সুরাহা করলাম না। তাহলে কি আমরা প্রগতিশীল আন্দোলন গড়ে তোলার মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাব? রাষ্ট্রকে পরিপূর্ণ বিকশিত না করেই বিপ্লবের ফল তো সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপাদক সম্পর্ক যদি আধুনিক বা পরিপক্ব না হয়, তবে কেমন করে সেখানে প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে, বিক্ষিপ্ত মন জানতে চায় তাঁর কাছে। বদরুদ্দীন উমর বামপন্থী তাত্ত্বিক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ। তিনি যদি মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রগতিশীলতায় সম্পৃক্ত না হওয়ার কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি অন্য প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে দেখতেন, তবে বাংলাদেশ বর্তমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা দিশা দেখতে পেত এত দিনে।
সুমনা সরকার গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়