মানুষ যে পরিবেশে বসবাস করে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করে, সে পরিবেশের বিঘ্ন সৃষ্টিতে সক্ষম ক্ষতিকর যেকোনো অবস্থার নাম দূষণ। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, মাটিদূষণের নাম আমরা সবাই জানি, এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কেও আমরা সবাই অবগত। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে মানবজীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানকে আমরা প্রত্যহ দূষিত করে চলেছি? সেই উপাদান হলো ভাষা।
ভাষা আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ভাষা ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এ ছাড়া আমরা এমন এক গর্বিত জাতি, যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি, বিশ্বদরবারে সুউচ্চ করেছি সব ভাষার মর্যাদা, আদায় করেছি আমাদের ভাষার জন্য রক্তদানের ইতিহাসকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি, জাতিসংঘের মাতৃভাষায় বক্তব্য দেওয়ার সম্মান। এ ক্ষেত্রে মাতৃভাষার সম্মান সবচেয়ে বেশি বজায় রাখার কথা আমাদেরই। তবে দুঃখের বিষয় হলো, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ একটি সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত আমরা বাংলা ভাষার সর্বজনীন প্রচলন ঘটাতে পারিনি।
১৯৮৪ সালে এক নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছিল, ‘সব সাইনবোর্ড এবং গাড়ির ফলক বাংলায় হতে হবে। তবে কেউ প্রয়োজন মনে করলে নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লিখতে পারবে।’ ১৯৮৭ সালে দেশের সব রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এমনকি সংবিধানেও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের ভাষা ‘বাংলা’। এত কিছুর পরও কি আমরা পেরেছি বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে?
সচিবালয়সহ সরকারি অধিদপ্তরগুলোতে বাংলার ব্যবহার অনেকাংশে চালু করা হলেও তা কি সর্বস্তরে প্রভাব ফেলতে পেরেছে? অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁ, বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্পকারখানার কথা বাদই দিলাম, ছোটখাটো দোকান, হোটেল বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও ইদানীং বাংলায় সাইনবোর্ড বানানো ইতিহাস হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কয়েক বছর পর হয়তো তা-ও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদিকে বানানরীতি নিয়েও আমরা এতটাই উদাসীন যে বানানগত ভুলের কারণে যে অর্থই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে আমাদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। অপর দিকে বাংলার সঠিক উচ্চারণের ব্যবহার খুঁজে পাওয়া দিন দিন দুষ্কর হয়ে পড়ছে।
বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশে নদীদূষণ ও ভাষাদূষণ দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এবং ক্রমাগত বাড়ছে।’
এ ছাড়া আমাদের মানসিকতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে বাংলা ভাষায় দৈনন্দিন কথাবার্তা বললে মনে হয়, আমার সামাজিক মর্যাদা বুঝি কমে গেল, অভিজাত শ্রেণিতে বুঝি আমার আর স্থান হলো না।
আমাদের সন্তানদের আমরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে পড়াতে বেশি পছন্দ করি, বাচ্চাদের সঙ্গে দৈনন্দিন কথাবার্তা ইংরেজিতে বলি। তাই তো আজ তরুণ প্রজন্মের মুখে ভাইয়ের বদলে ব্রো, বোনের বদলে সিস, বন্ধুর বদলে ফ্রেন্ড, মায়ের বদলে মম, বাবার বদলে ড্যাড শোভা পাচ্ছে। দূষিত হতে হতে আসল অবস্থাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের এই বাংলা ভাষার।
এত কিছুর পরও প্রতিবছর ফেব্রুযারি মাস এলেই আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার অঙ্গীকার করি এবং ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তবে সেটা যেন শুধু ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ না থাকে।
সুতরাং আমাদের স্বকীয়তা রক্ষায় এবং আমাদের ভাষাকে সমুন্নত রাখতে আমাদেরই প্রচেষ্টা চালাতে হবে আমাদের ভাষাকে অবহেলা করার সামাজিক রীতি থেকে বেরিয়ে আসার। তবেই আমরা পারব আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি স্বকীয় ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি উপহার দিতে। শুধু ফেব্রুয়ারি ঘিরে না থাক ভাষার প্রতি আমাদের আবেগ আর অনুভূতি। আরও দূষিত না হোক আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা।
নুসরাত জাহান
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়