গ্রিক দার্শনিক প্লেটো মনে করতেন, শিক্ষার প্রধানতম লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তিকে তার পুরোপুরি সত্তায় বিকশিত করা। রাষ্ট্রীয় জীবনে তার নির্ধারিত ভূমিকা পালন করার উপযোগী করে প্রস্তুত করা। আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে তিনি দার্শনিক প্রভুর প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেছেন এবং তাঁর মতে, মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন দার্শনিক প্রভু, যাদের গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষা।
এ দেশে শিক্ষাব্যবস্থার তথা প্রাথমিক শিক্ষার বনিয়াদ বা ভিত্তি রচিত হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ হচ্ছে সর্বোত্তম বিনিয়োগ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে একদিকে যেমন তিনি গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, আবার অন্যদিকে নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছেন।
একই সঙ্গে তিনি শিক্ষাকে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থাকে উপযুক্ত মানদণ্ডে ও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে যা ছিল প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিভঙ্গির সম্প্রসারণ।
জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, নৈতিক, মানবিক, নান্দনিক, আধ্যাত্মিক ও আবেগিক বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধে, বিজ্ঞানমনস্কতায়, সৃজনশীলতায় ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন ও শিক্ষার সঠিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণে বর্তমান সরকার নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
গত ১৪ মাসে প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখেছি, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুবিধা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের জটলার অবসান ঘটিয়ে সুষ্ঠু নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষক–ছাত্রের আদর্শিক অনুপাত নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
শিক্ষানীতি অনুযায়ী, নতুন কারিকুলাম অনুসরণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষা গ্রহণ কার্যক্রমকে আনন্দদায়ক করতে বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্টের আয়োজন করা হচ্ছে, যেমন গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সরকারি দিবস উদ্যাপনে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
এতসব উদ্যোগের পরও আমরা কি আমাদের কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ড তথা লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পেরেছি? প্রশ্নটির সঠিক উত্তর হয়তো হবে এ বিষয়ে আমাদের আরও অনেকটা পথ পেরোতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা (০৪) গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে স্মার্ট নাগরিক গড়ে তুলতে হলে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:
প্রথমত, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে—যেমন সবচেয়ে সুখী বাচ্চাদের দেশ নেদারল্যান্ডস কিংবা সবচেয়ে নিয়মানুবর্তী শিশুদের দেশ জাপান থেকে শিক্ষা নিয়ে—আমাদের শিশুদের কীভাবে আরও বেশি স্বনির্ভর, ন্যায়নিষ্ঠ, সহমর্মী, দায়িত্বশীল, উদ্যমী, বিজ্ঞানমনস্ক ও সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, পাঠ্যপুস্তক সেভাবে ঢেলে সাজাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, অভিভাবকদের শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে বাধ্যতামূলকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে, ঠিক যেমনটা প্লেটো তাঁর ‘দ্য রিপাবলিক’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ লক্ষ্যে অভিভাবক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
তৃতীয়ত, ‘মিড ডে মিল’–এর মতো ফলপ্রসূ কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর স্বাভাবিক ও মনোদৈহিক বিকাশ নিশ্চিত করতে নিয়মিতভাবে শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
চতুর্থত, তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষা আধেয়গুলো শিশুর জন্য কীভাবে আরও বেশি আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষক করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সেরা আধেয় প্রস্তুতকারককে পুরস্কৃত করা যেতে পারে।
পঞ্চমত, শিশুকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক আচার, কৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তার নৈতিকতা, নান্দনিকতাবোধ, সুকুমার বৃত্তির বিকাশে সহায়তা করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষাসংক্রান্ত প্রাথমিক জ্ঞান ও এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শিশুর শ্রেণিভিত্তিক অর্জনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
শেষ কথা: প্রতিটি শিশুই এক একটি পৃথক সত্তা, তার সঠিক বিকাশ বা শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই নিশ্চিত হবে সুস্থ্, সুন্দর ও সমৃদ্ধিময় আগামী।
মো. সোহরাব হোসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, চারঘাট, রাজশাহী
hossainshohrub@gmail.com