নির্বাচনের রাজনীতি: নাটোর-৪

আ.লীগে সাংসদবিরোধী জোট

১৯৯১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত চারবার নাটোর-৪ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন আবদুল কুদ্দুস। মাঝখানে ২০০১ সালে তিনি বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আবারও আসনটিতে কোন্দলে নাকাল হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। চারবারের সাংসদ আবদুল কুদ্দুসকে ঠেকাতে এবারও এককাট্টা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁদের এই দ্বন্দ্ব বিএনপির জন্য হয়তো সুখবর। 

নাটোর-৪ (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের বর্তমান সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবদুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্য, পারিবারিক উন্নয়ন, দলীয় নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন, খারাপ আচরণ এবং হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় জড়ানোর মতো অভিযোগ তুলেছেন দলীয় নেতারাই। সভা করে লিখিত অভিযোগ পাঠানো হয়েছে দলের উচ্চপর্যায়ে। সাংসদকে এলাকায় ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে আগামী নির্বাচনে তাঁরা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিও তুলেছেন জোরেশোরে।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনেও একই দাবিতে ‘কুদ্দুসবিরোধী জোট’ গড়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগে। এই জোটের প্রার্থী ছিলেন বড়াইগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এশারত আলী। তৃণমূলের মত উপেক্ষা করে কুদ্দুসকে মনোনয়ন দেওয়ায় আসনটি বিএনপির হাতে চলে যায়। এখানে মোট ভোটার ৩ লাখ ৮১ হাজার ৬৯ জন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার ‘কুদ্দুসবিরোধী আন্দোলনে’ গুরুদাসপুরে নেতৃত্বে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র শাহনেওয়াজ আলী এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সরকার এমদাদুল হক মোহাম্মদ আলী। আর বড়াইগ্রাম উপজেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ও বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী। শাহনেওয়াজ ও সিদ্দিকুর জোটবদ্ধ হয়ে কুদ্দুসের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে প্রচারও চালাচ্ছেন। দুই উপজেলাতেই সভা-সমাবেশ করে সাংসদের নানা অনিয়ম তুলে ধরা হচ্ছে। সাংসদবিরোধীদের দাবি, ২০১৭ সালের ২১ জুন থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২০টি মিছিল-সমাবেশ করেছেন তাঁরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

গত ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে মেয়র শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে গুরুদাসপুর পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে সমাবেশ হয়। দুই উপজেলার সাংসদবিরোধী নেতা-কর্মীরা সেখানে অংশ নেন। এতে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাজেদুর রহমান খান, জেলা যুবলীগের সভাপতি বাসিউর রহমান খান চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
একই মাঠে ১৭ জানুয়ারি সাংসদ আবদুল কুদ্দুস সমাবেশ করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সাংসদ শফিকুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও নাটোর-১ আসনের সাংসদ আবুল কালাম আজাদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

মেয়র শাহনেওয়াজ ও সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ২০০১ সালে দলীয় কোন্দলের কারণে আসনটি হাতছাড়া হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে আবদুল কুদ্দুসের পক্ষে খেটে আসনটি পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বদলে যান তিনি। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দাম্ভিকতা বেড়ে যায় কুদ্দুসের। দলে ক্ষোভের কারণে ‘কুদ্দুসবিরোধী জোট’ গড়ে উঠেছে।

সাংসদবিরোধী নেতাদের দাবি, ২০০১-এর নির্বাচনে সাংসদ কুদ্দুসের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ছিল, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। প্রার্থী পরিবর্তন না হলে আসনটি ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
তবে সাংসদ কুদ্দুসের অনুসারী হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, দলের ভেতর থাকা বঞ্চিত কিছু নেতা-কর্মী সাংসদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম, বিষোদ্গার কাজে আসবে না। গুরুদাসপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, দলের ভেতর থাকা একটি চক্র হাইব্রিড আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের কিছু লোক নিয়ে সাংসদের বিপক্ষে কাজ করছে। তাদের কারণে দলের ভেতর কোন্দল, উপদলীয় কোন্দল ছড়িয়ে পড়ছে।
সাংসদ কুদ্দুস তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতি তিনি করেন না। দলের ভেতর থাকা কিছু নেতা সুবিধা আদায় করতে না পেরে উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টি করছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও এই চক্রটি তাঁর বিরুদ্ধে ছিল। এতে তিনি বিচলিত নন।

‘বিএনপি অভিভাবকহীন’
২০০১ সালে বিএনপির প্রার্থী এম মোজাম্মেল হক সাংসদ নির্বাচিত হলেও নানা কারণে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। ২০০৭ সালে এলাকা ছেড়ে তিনি ঢাকায় চলে যান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর আবারও তিনি এলাকা ছেড়ে ঢাকায় যান। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী। বিএনপির মনোনয়ন পেতে আরও প্রচার চালাচ্ছেন গুরুদাসপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. আবদুল আজিজ। এই দুই প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে স্থানীয় বিএনপিতে উপদলীয় কোন্দল রয়েছে।
আবদুল আজিজ ছাড়াও সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন ও পৌর বিএনপির সভাপতি মশিউর রহমানের বক্তব্য হচ্ছে, মোজাম্মেল হক এলাকায় থাকেন না, সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন। আসনটি পুনরুদ্ধারে ও দলীয় কোন্দল নিরসনে তাঁরা জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদারকে (দুলু) চাইছেন।
মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সাংসদ থাকার সময় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এলাকায় না থাকলেও মুঠোফোনে দলের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
রুহুল কুদ্দুস তালুকদার মনে করেন, মোজাম্মেল হকের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এখানে বিএনপি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। তবে দলে কোন্দল নেই। আছে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। দল মনোনয়ন দিলে তিনি প্রার্থী হবেন বলে জানালেন।

জাপার ‘অভিমানী’ নেতা
প্রধান দুই দলের বাইরে এখানে নির্বাচন করতে চান জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ আবুল কাশেম সরকার। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে আবার জাতীয় পার্টিতে ফিরে যান। আবুল কাশেম বলেন, ২০০১ সালে অভিমান করে দল ছেড়েছিলেন তিনি। পরে দলীয় প্রধানের অনুরোধে ফিরে আসেন। আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে একক কিংবা মহাজোটের প্রার্থী থাকবেন তিনি।