
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত কি না, তা রাজনৈতিক দলগুলোকে বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার দাবিসহ নিত্যনতুন ইস্যু পলাতক ফ্যাসিস্টের পুনর্বাসনের পথ সুগম করে দিচ্ছে কিনা, সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূতি উপলক্ষে ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভা এবং শহীদ, গুম-খুনের শিকার পরিবারের সম্মানে আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে তারেক রহমান এই আহ্বান ও প্রশ্ন রেখেছেন।
তারেক রহমান বলেন, ‘কোনো কোনো দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবি তুলেছেন। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী বিধান রয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায়, ভৌগোলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই মুহূর্তে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা কতটুকু উপযোগী, বা উপযোগী কিনা ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ রাখব।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, নিত্যনতুন ইস্যু যদি আমরা সামনে নিয়ে আসতে থাকি, এর সুযোগে ষড়যন্ত্রকারীরা আবারও মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ পাবে।’
তারেক রহমান জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূতি উপলক্ষে ৩৬ দিনের কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি ছিলেন। তিনি ভিডিও বক্তব্য দেন।
খালেদা জিয়া রক্তস্নাত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতির সামনে আসা সুযোগ কাজে লাগাতে ঐক্য বজায় রাখার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছর ফ্যাসিস্টদের নির্মম অত্যাচার, গ্রেপ্তার, হত্যা, খুনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী। ছাত্রজনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন বাংলাদেশে গড়বার। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার। তা দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সব শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আহতদের প্রতি সমবেদনা জানান বিএনপির চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, তাঁদের এই আত্মত্যাগ জাতি জাতি চিরকাল মনে রাখবে। গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার যাঁরা শিকার হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পরিবারের সম্মানজনক পুনর্বাসন এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে যে কোনো মূল্যে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্য এবং বিগত আওয়ামী লীগের সময় গুম-খুনের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির এই অনুষ্ঠানে তারেক রহমানের বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল জাতীয় সংসদের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য কয়েকটি দলের দাবির প্রসঙ্গটি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে হলে বাংলাদেশকে তাঁবেদার মুক্ত রাখতে হলে এই মুহূর্তে জনগণের ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিশীলতা সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠতে পারে কিনা, এ বিষয়েগুলো আরও একবার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার জন্য সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিনীত আহ্বান এবং অনুরোধ করব।’
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে যে সব বীর সন্তানেো দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তাঁদের আত্মত্যাগকে বিবেচনায় নেওয়ার জন্য প্রতিটি দলের নেতা-কর্মী এবং সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি আহ্বান জানান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘আসুন, আমরা যার যার ইচ্ছামতো শর্তের তালিকা না বাড়িয়ে শহীদদের চেতনায় দেশকে উপলব্ধি করে বাংলাদেশকে দেখার চেষ্টা করি। শহীদদের আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশকে গড়ে তুলি।’
তারেক রহমান বলেন, তিনি ও তাঁর দল বিএনপি দেশে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাকে একটি চিরস্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে চান। যেখানে সব রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক থাকবেন জনগণ। নির্বাচিত সরকার জন প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থ হলে নির্ধারিত মেয়াদের পর সেই সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতাও জনগণের হাতে থাকবে। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে এভাবে জনপ্রতিনিধিদের জনগণের মুখাপেক্ষী করে দেওয়া গেলে রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে দুনীতি ও দুর্বৃত্তায়ন কমে আসবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, এখন সুচতুরভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে যে, বিএনপি সংস্কার মানছে না বলে সংস্কার পিছিয়ে যাচ্ছে। বিএনপিকে দোষারোপ করা ঐক্যের জন্য সহায়ক হবে না। তিনি বলেন, ‘ঐক্যের প্রশ্নে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমাদের কোনো আপস নেই। আমরা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চাই, নারীর ক্ষমতায়ন চাই, ধর্মীয় স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস করব না। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আমরা পরিবর্তন চাই।’
বিএনপিকে প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন স্থায়ী কমিটির মির্জা আব্বাস। তিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ভূমিকার উল্লেখ করে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে মনে হয় সুচতুর কৌশল তৈরি হচ্ছে যাতে বিএনপি ক্ষমতায় না আসে। আমরা কখনো বলি নাই, আমরা ক্ষমতায় যাব। আজকে বিএনপি প্রতিপক্ষ বানানোতে কোনো লাভ নেই। জাতির ভেতরে কোনো অনৈক্য সৃষ্টি করা যাবে না। এইটা না হলে নির্বাচন হবে না, ওইটা না হলে নির্বাচন করা যাবে না—এ সব কথাবার্তা অনৈক্যের কথা।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যের একটা প্ল্যাটফর্ম হবে, এটাই সেই প্ল্যাটফর্ম। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য ধরে রাখতে হবে সমুন্নত রাখতে হবে। নতুন বাংলাদেশ সবার আগে বাংলাদেশ এটাই হবে আমাদের নীতি।’
নির্বাচনে অংশীদারত্ব চায় শহীদ পরিবার
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদের উচ্চকক্ষ (প্রস্তাবিত) ও নিম্ন কক্ষে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব চেয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা।
শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শহীদ পরিবার থেকে অংশীদারত্ব রাখতে হবে।
রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী বলেন, ‘আবু সাঈদ যদি বুক পেতে না দাঁড়াত, দেশের পরিস্থিতি (পরিবর্তন) এত সহজ হয়ে আসত না। আবু সাঈদ গুলির সামনে বুক পাতিয়ে সকল পেশাজীবী, দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে সাহস জুগিয়েছিল।’
সরকার থেকে শহীদ পরিবারগুলোর খোঁজখবর নেওয়া হয় না বলে সভায় অভিযোগ করেন জুলাই অভ্যুত্থানে উত্তরায় শহীদ হওয়া আবদুল্লাহ বিন জাহিদের মা ফাতেমাতুজ জোহরা। তিনি বলেন, যাদের রক্তের বিনিময়ে এই পরিবর্তন, এই সরকার, তারা এখনই খোঁজ নেয় না, পরে আর কী হবে!
বিগত সরকারের আমলে গুমের শিকার বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর অভিযোগ করে বলেন, ‘গুম কমিশনে অভিযোগ জমা দেওয়ার পর বারবার তাঁরা ফোন করে আমাদের কাছ থেকে তথ্য নিতে চাচ্ছে। জানতে চেয়েছে, ইলিয়াস আলী ফিরে এসেছেন কি না। এসব থেকে ধারণা করা যায়, কমিশনের কাজের গতি কী, কতটা গুরুত্ব দিয়ে তারা কাজ করছে।’ ট্রাইব্যুনালে গুমের কোনো আইন না থাকার প্রসঙ্গটি টেনে তাহসীনা বলেন, ‘মামলা করব কীভাবে? সেই ২০১২ সালে জিডি করেছি, হাইকোর্টে রিটও করেছিলাম।’ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাষ্ট্র কেন বাদী হয় না, এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম বলেন, ‘যাঁদের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ, তাঁদের বিচার করতে হবে। শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আমরা লড়ব।’
গুমের শিকার পুরান ঢাকার ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের মেয়ে আবিদা ইসলাম বলেন, ‘১২ বছর ধরে বাবাকে খুঁজছি। ৫ আগস্টের পরে মনে হয়েছিল, বাবাকে ফেরত পাব, কিন্তু খোঁজই পাইনি।’
আরও বক্তব্য দেন গুমের শিকার নুরুজ্জামান জনির ছোট ভাই মনিরুজ্জামান, চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতা শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিমের বাবা শফিউল আলম, ছাত্রলীগের হামলায় নিহত বিশ্বজিৎ দাসের বাবা অনন্ত চন্দ্র দাস প্রমুখ।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আবদুল হালিম, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ, জাতীয় নাগরিক কমিটির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, গণ-অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, এবি পার্টির সভাপতি মজিবর রহমান মঞ্জু, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মনঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বক্তব্য দেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন অনুষ্ঠান আয়োজক কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বিএনপির যুগ্মমহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, নাহরিন ইসলাম খান, আবদুল্লাহ আল মামুন ও এহসান মাহমুদ। অনুষ্ঠানের শুরুতে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান ও বিগত আওয়ামী লীগর সময়ে গুম, খুনসহ দুঃশাসনের ওপর তৈরি করা একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে শহীদ ইয়ামিনের বাবা মহিউদ্দিন, শহীদ নাফিসের মা নাসিমা আক্তার বাবা গোলাম রহমান ও মায়ের ডাক এর সানজিদা ইসলামের হাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ক্রেস্ট তুলে দেন।