লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শুক্রবার লন্ডনের হোটেল ডরচেস্টারে
লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শুক্রবার লন্ডনের হোটেল ডরচেস্টারে

লন্ডন বৈঠকের পর এখন বিএনপির দৃষ্টি নির্বাচনে , কী ভাবছে অন্য দলগুলো

লন্ডন বৈঠকের পর বেশ উচ্ছ্বসিত বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এখন তাদের দৃষ্টি জাতীয় নির্বাচনের দিকে। একই সঙ্গে এখন বিএনপির নেতা-কর্মীদের অধীর অপেক্ষা, দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসিত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরার দিকে।

অন্যদিকে লন্ডন বৈঠকের পর কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল। যারা আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে।

গত শুক্রবার লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে আগামী রমজান শুরুর আগের সপ্তাহে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ও সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের এত দিনের মনোভাবের ব্যাপক পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়।

অন্যদিকে লন্ডন বৈঠকের পর কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল। যারা আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার আভাস দিচ্ছে।

যদিও লন্ডন বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের একান্ত আলোচনায় নির্বাচনের সময় ছাড়া আর কী কী বিষয়ে কথা হয়েছে, তা নিয়ে সব মহলে কৌতূহল রয়েছে। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, এ বৈঠকে বহুল আলোচিত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা ও মিয়ানমারের রাখাইনে খাদ্যসহায়তা পাঠানোর জন্য মানবিক করিডর বা ত্রাণ চ্যানেলের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এমনকি বিএনপি এর আগে সরকারের যে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছিল, সেটাও আলোচনায় তোলা হয়নি। এমনকি পদত্যাগের দাবি করা তিন উপদেষ্টার একজন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন। তিনি তারেক রহমানকে বৈঠকে অভ্যর্থনা জানান।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিংয়ে দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা। লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ১৩ জুন ২০২৫

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লন্ডন বৈঠকে উপস্থিত থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি বিষয়ে (করিডর) আমরা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম, তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছিলাম। এটাকে রাজনীতির স্বাভাবিক চর্চা হিসেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া সরকার তার দিক থেকে বৈঠকে কাকে রাখবে, সে সিদ্ধান্ত তো সরকারের। এ ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দল শিষ্টাচারের পরিচয় দেবে, এটাই স্বাভাবিক।’

তবু অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের একান্ত বৈঠক ঘিরে বিভিন্ন মহলে এমন আলোচনাও রয়েছে—এ বৈঠকে এমন কী হয়েছে যে এক সপ্তাহর ব্যবধানে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে মত পাল্টালেন। যেখানে ৬ জুন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার আগে একাধিক উপদেষ্টা ও সরকারঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাতে প্রধান উপদেষ্টা সম্মত হননি। তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেন।

লন্ডন বৈঠক, বিএনপির প্রতিক্রিয়া ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এ বৈঠকে নির্বাচনের নতুন সময় নির্ধারণ ছাড়াও ভবিষ্যতে জাতি গঠনের ব্যাপারেও দুই নেতার মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

তবু অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের একান্ত বৈঠক ঘিরে বিভিন্ন মহলে এমন আলোচনাও রয়েছে—এ বৈঠকে এমন কী হয়েছে যে এক সপ্তাহর ব্যবধানে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে মত পাল্টালেন।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বৈঠকে শুধু দেশের বর্তমান পরিস্থিতিই নয়, ভবিষ্যৎ জাতি গঠনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। ভবিষ্যতে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে অধ্যাপক ইউনূসের পরামর্শ ও সহায়তা চাইবে। এ ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে বিএনপি।

একটি বিষয়ে (করিডর) আমরা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম, তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছিলাম। এটাকে রাজনীতির স্বাভাবিক চর্চা হিসেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া সরকার তার দিক থেকে বৈঠকে কাকে রাখবে, সে সিদ্ধান্ত তো সরকারের। এ ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দল শিষ্টাচারের পরিচয় দেবে, এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

অবশ্য ১১ জুন লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বা চ্যাথাম হাউস আয়োজিত আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূস ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং গণভোটের ধারণাও নাকচ করে দেন।

এ ছাড়া এর আগে কোনো কোনো মহল প্রচারণার চেষ্টা হয়েছিল যে অধ্যাপক ইউনূস নির্বাচন বিলম্বিত করতে চান বা তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। চ্যাথাম হাউসের আলোচনায় ইউনূস সেটাও নাকচ করে দেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের ক্যাবিনেটের (উপদেষ্টা পরিষদ) কারোরই এ ধরনের কিছু করার ইচ্ছা নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে মসৃণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং একটি নির্বাচিত, জনসমর্থনপ্রাপ্ত সরকারের কাছে ক্ষমতা তুলে দেওয়া।’

ভবিষ্যতে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে অধ্যাপক ইউনূসের পরামর্শ ও সহায়তা চাইবে। এ ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে বিএনপি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূসের এমন খোলামেলা বক্তব্য এবং তারেক রহমানের সঙ্গে আন্তরিক আলোচনা বিএনপিকে আশ্বস্ত করে তোলে। নির্বাচন প্রশ্নে এত দিন অধ্যাপক ইউনূসের সমালোচনা করে বিএনপির নেতারা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা এখন তাঁরা ভুলে যেতে চান।

রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আলোচনাও আছে যে বিএনপি কয়েক মাস ধরে নানা কারণে রাজনীতিতে অনেকটা চাপে পড়ে গিয়েছিল। লন্ডন বৈঠকের মধ্য দিয়ে অনেক দিন পর দলটি রাজনৈতিকভাবে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে এল।

অবশ্য বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল কথা হলো, এ বৈঠকে প্রমাণিত হয়েছে, জাতির ক্রান্তিলগ্নে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি এবং এ সময়ে ঐক্যবদ্ধ থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে কোনো দল কোনো বিষয়ে ভুল করতে পারে। এখন প্রতিদিনের ভুলভ্রান্তি নিয়ে পড়ে থাকলে আমরা এগোতে পারব না; আমরা নতুন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখছি, সেটা বাস্তবায়ন করতে পারব না।’

জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ এই ঘরানার দলগুলো মনে করে, লন্ডন বৈঠকের পর সরকার ও বিএনপি একসঙ্গে যৌথ ঘোষণা দেওয়ায় মানুষের কাছে বার্তা গেছে যে বিএনপিই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি। বোঝানো হচ্ছে, সরকার ও বিএনপি সমশক্তি। এর মাধ্যমে অন্য দলগুলোকে অবজ্ঞা করা হয়েছে।

এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আলোচনাও আছে যে নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হলেও গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ, জুলাই সনদ কার্যকর করা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাযজ্ঞের জন্য আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন কোনো জটিলতা তৈরি হয় কি না। কারণ, এনসিপি শুরু থেকেই জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ, জুলাই সনদ কার্যকর করা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাযজ্ঞের বিচার দাবি করে আসছে। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য দলগুলো এ বিষয়ে সোচ্চার। যদিও লন্ডন বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি বলেছে, সংস্কার ও জুলাই সনদের বিষয়গুলো ঐকমত্যের ভিত্তিতে হবে। আর বিচারপ্রক্রিয়াও চলমান থাকবে।

জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ এই ঘরানার দলগুলো মনে করে, লন্ডন বৈঠকের পর সরকার ও বিএনপি একসঙ্গে যৌথ ঘোষণা দেওয়ায় মানুষের কাছে বার্তা গেছে যে বিএনপিই একমাত্র রাজনৈতিক শক্তি। বোঝানো হচ্ছে, সরকার ও বিএনপি সমশক্তি। এর মাধ্যমে অন্য দলগুলোকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এতে অন্য দলগুলো নির্বাচনের মাঠে প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিবন্ধকতায় পড়বে। জামায়াত এ বক্তব্য অধ্যাপক ইউনূসকে জানানোর চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। লন্ডন বৈঠকের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে জামায়াত গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন করায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে আমীর খসরুর মত ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি বৃহৎ রাজনৈতিক দল এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। অন্য দল কি বিএনপির সমকক্ষ হতে পারে? নির্বাচনের একটা সময় ঠিক হয়েছে মাত্র। এ ব্যাপারে সবাই তো একমত। জামায়াতও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছে। এখানে অন্য দলকে অবজ্ঞার কী আছে।

অন্যদিকে লন্ডন বৈঠক সফল হওয়ায় বিএনপির পাশাপাশি তাদের সমমনা দলগুলোও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। বিবৃতি দিয়ে বলেছে, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়েছে। নির্বাচনের পথ সুগম হয়েছে। বিএনপির দলীয় সূত্রগুলোও বলছে, তাদের দৃষ্টি এখন নির্বাচনের দিকে। সে লক্ষ্যে পরবর্তী দলীয় কার্যক্রম ঠিক করা হবে।