জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ভবন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ভবন

জাকসু নির্বাচন ঘিরে সরগরম ক্যাম্পাস 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন হবে ১১ সেপ্টেম্বর। তিন দশক পর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচন ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। ছাত্রসংগঠন, সম্ভাব্য প্রার্থী ও সমর্থকেরা প্যানেল গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আবাসিক হল, বটতলা, ক্যাফেটেরিয়া—সব জায়গায় আলোচনার মূল বিষয় জাকসু নির্বাচন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এত বছর নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় তাঁদের অধিকার আদায়ে কার্যকর প্ল্যাটফর্ম ছিল না। রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হওয়ার বদলে নিজেদের দলীয় স্বার্থে কাজ করেছে। জাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করবেন বলে তাঁরা আশা করছেন।

বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আবু রায়হান কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বছর জাকসু না থাকায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে। গণরুম, গেস্টরুম কালচার টিকে গেছে। এবার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের হয়ে কথা বলবেন, সেই আশায় আছি।’

জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক শিবলী নোমান মনে করেন, ১৯৭৩ সালের আইনে জাকসু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সংসদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা। তিনি বলেন, ‘৩৩ বছর ধরে এই নির্বাচন না হওয়া দুঃখজনক এবং স্পষ্টতই আইনের ব্যত্যয়।’ তবে এই শিক্ষক সতর্ক করে বলেন, জাকসু কোনো জাদুর কাঠি নয়। শিক্ষার্থীদের সংকট সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনের সদিচ্ছা দরকার। জাকসু হবে তাদের অন্যতম অংশীদার।

প্যানেল গোছানোয় তোড়জোড়

শক্তিশালী প্যানেল গড়তে তৎপরতা চলছে সব পক্ষে। গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ এককভাবে প্যানেল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছাত্রসংগঠনটির আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান বলেন, এখনই জোটে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। তবে শেষ মুহূর্তে আলোচনার সুযোগ থাকবে।

ইসলামী ছাত্রশিবিরও দীর্ঘদিন পর প্রকাশ্যে সক্রিয়। কয়েক মাস ধরে তারা মেডিকেল ক্যাম্পসহ সামাজিক কর্মসূচি চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মহিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা এককভাবে লড়ার সক্ষমতা রাখি। তবে গণ-অভ্যুত্থানপন্থী কোনো শক্তি চাইলে জোট করতে রাজি আছি।’ তিনি আরও বলেন, তাঁদের প্যানেলে নারী, হিন্দু ও আদিবাসী শিক্ষার্থীও থাকবেন।

প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত দুটি প্যানেল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। একটি প্যানেলে থাকতে পারে ছাত্র ইউনিয়ন (অদ্রি-অর্ক), জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট (ফাইজা), ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ কয়েকটি সমমনা সাংস্কৃতিক সংগঠন।

ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ফাইজান আহমেদ (অর্ক) বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে যেসব সংগঠনের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া রয়েছে, একসঙ্গে আন্দোলন করেছি এবং আমাদের সমমনা সেসব সংগঠনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্যানেল দেওয়া হতে পারে।’

অন্য প্যানেলে থাকতে পারে ছাত্র ইউনিয়নের অন্য অংশ (জাহিদ-তানজিম), জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট (মেঘ), জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন। এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের আরেকাংশের সাধারণ সম্পাদক তানজিম আহমেদ বলেন, ‘আমরা যারা একসঙ্গে দীর্ঘদিন রাজপথে ছিলাম, লড়াই করেছিলাম, তারা মিলে প্যানেল করার চিন্তা করছি।’

ছাত্রদলে ‘কোন্দল’

অন্যরা যখন প্রার্থী পদ নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, তখন ছাত্রদলে দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ ‘কোন্দল’। ১৭টি আবাসিক হল ও শাখা কমিটি বর্ধিত করার পর নবগঠিত কমিটিতে বিতর্কিত ব্যক্তিদের পদ দেওয়ার অভিযোগে একাংশ বিক্ষোভ করে। এর পর থেকে ওই অংশের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে ‘শোডাউন’ দিচ্ছেন। অন্যদিকে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক, সদস্যসচিবসহ শীর্ষ পাঁচ নেতাকে স্বাভাবিক সময়ের মতো ক্যাম্পাসে দেখা যাচ্ছে না। 

জাকসু নির্বাচনে এককভাবে প্যানেল ঘোষণা করা হবে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, ‘যাঁরা ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নামে হট্টগোল করছেন, তাঁদের সবারই পদ আছে। দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই কমিটি দেওয়া হয়েছে।’

‘সংগঠন দেখে ভোট দেওয়ার সময় শেষ’

সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে। আসন্ন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে ১০ আগস্ট। সেদিনই প্রকাশ করা হয়েছে খসড়া ভোটার তালিকা ও আচরণবিধি। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ও চূড়ান্ত আচরণবিধি প্রকাশ হবে ১৭ আগস্ট। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমাদান ১৮ ও ১৯ আগস্ট। খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ২৫ আগস্ট। কমিশনের সদস্যসচিব জানান, যাচাই-বাছাই শেষে জাকসু নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ১২ থেকে সাড়ে ১২ হাজারের মতো হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত জাকসু নির্বাচনকে ঘিরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোতে প্রশাসন সজাগ রয়েছে। খসড়া ভোটার তালিকা এবং খসড়া আচরণবিধি নিয়ে শিক্ষার্থীরা মতামত দিচ্ছেন। তিনি সবার সহযোগিতা চান। 

প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বলছেন, দলীয় মতাদর্শ নয়, ব্যক্তিগত যোগ্যতা কেমন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবেন কি না, এসব দেখে ভোট দেবেন তাঁরা।

লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মুবাশ্বিরা মাইশা বলেন, ‘টাকা দিয়ে ভোট কেনা বা শুধু দল, সংগঠন দেখে ভোট দেওয়ার সময় শেষ। আমরা দেখব কে কাজ করেছে, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই।’