শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা। কার্জন হলের সামনে
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা। কার্জন হলের সামনে

ডাকসু নির্বাচন: উমামার প্যানেলের শক্তির দিক ও চ্যালেঞ্জ কী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ নামের একটি প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। ডাকসুর ভিপি (সহসভাপতি) পদে তিনি প্রার্থী হয়েছেন।

উমামা ও তাঁর প্যানেলের প্রার্থীরা মনে করছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকাই তাঁদের শক্তি। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা দলীয় প্রভাবমুক্ত ছাত্ররাজনীতি দেখতে চান। এ কারণে তাঁরা এই প্যানেলকে ভোট দেবেন।

ডাকসু নির্বাচন আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। এই নির্বাচনে ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ আলাদা প্যানেল দিয়েছে। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো দুটি প্যানেলে নির্বাচন করছে। পূর্ণ ও আংশিক মিলিয়ে প্যানেল ১০টির মতো। তবে পাঁচটি প্যানেলের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার মধ্যে একটি উমামার প্যানেল।

ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ উমামা ফাতেমা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীদের সংগঠিত করে আন্দোলনে যুক্ত করার ক্ষেত্রে উমামার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা

শিক্ষার্থীরা বলছেন, এবারের ভোটে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কোনো প্যানেলই এককভাবে এগিয়ে নেই; বরং প্রার্থীর ব্যক্তিগত পরিচিতি ও ভাবমূর্তি বড় হয়ে উঠছে।

ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ উমামা ফাতেমা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীদের সংগঠিত করে আন্দোলনে যুক্ত করার ক্ষেত্রে উমামার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরে গত বছরের অক্টোবরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্রের দায়িত্ব পান উমামা। এর মাধ্যমে ক্যাম্পাসের বাইরেও পরিচিতি লাভ করেন। অবশ্য পরে উমামা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছেড়ে দেন। তখন তিনি সমন্বয়ক পরিচয় ব্যবহার করে অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ তুলে আলোচনায় আসেন।

উমামা একসময় গণসংহতি আন্দোলনের ছাত্রসংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব ছিলেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ছাত্র ফেডারেশন থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। ডাকসুর ২৮টি পদেই তাঁর নেতৃত্বাধীন প্যানেলে প্রার্থী রয়েছে।

ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনগুলোর সূত্রে জানা গেছে, বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠনের প্রতিরোধ পর্ষদ চেয়েছিল ভিপি পদে উমামা তাঁদের প্রার্থী হোক। কিন্তু উমামা তাতে রাজি হননি। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করতেই আগ্রহী ছিলেন।

ডাকসু নির্বাচন আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। এই নির্বাচনে ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ আলাদা প্যানেল দিয়েছে। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো দুটি প্যানেলে নির্বাচন করছে। পূর্ণ ও আংশিক মিলিয়ে প্যানেল ১০টির মতো। তবে পাঁচটি প্যানেলের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার মধ্যে একটি উমামার প্যানেল।

উমামার প্যানেলের শক্তির জায়গা চারটি

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ২৭ আগস্ট ২০২৫

উমামা ফাতেমার প্যানেল গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে গতকাল শুক্রবার কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মতে, ডাকসুর ভোটে উমামা ফাতেমার শক্তির জায়গা চারটি: এক. উমামার প্যানেল ছাত্রীদের ভোটের একটি বড় অংশ পেতে পারে। ডাকসুতে মোট ভোটের প্রায় ৪৮ শতাংশ ছাত্রীদের। দুই. বিজ্ঞানবিষয়ক বিভাগগুলোর শিক্ষার্থীদের ভোট সাত হাজারের বেশি। উমামা যেহেতু বিজ্ঞানের ছাত্রী, সেহেতু তিনি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ভোট আকর্ষণে সফল হতে পারেন। তিন. উমামার প্যানেল মনে করছে, জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থীদের ভোট তারা বেশি পাবে। এই হলে ২ হাজার ২২২টি ভোট রয়েছে, যা মোট ভোটের প্রায় ৬ শতাংশ। জগন্নাথ হলে ইসলামের বাইরে অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ছাত্ররা থাকেন। চার. জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে উমামার ভূমিকা ও পরিচিতি তাঁর ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। উমামার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের তেমন কোনো অভিযোগ ওঠেনি।

উমামার প্যানেলের দুজন প্রার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলে ভিপিসহ ছয়জন প্রার্থী নারী। নারী শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তাঁর প্রচারণায়।

উমামার প্যানেলের চ্যালেঞ্জ কী, সে বিষয়েও কথা বলেছেন প্যানেলটি গঠনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, তাঁদের চোখে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, উমামাসহ কয়েকজন ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ। বাকিদের বড় পরিচিতি নেই। উমামাদের বাইরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয়দের আরও প্যানেল আছে। নারী প্রার্থী আরও আছেন। এসব বিষয় তাঁর প্যানেলের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনগুলোর সূত্রে জানা গেছে, বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠনের প্রতিরোধ পর্ষদ চেয়েছিল ভিপি পদে উমামা তাঁদের প্রার্থী হোক। কিন্তু উমামা তাতে রাজি হননি। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করতেই আগ্রহী ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী অনাবাসিক (হলে থাকেন না)। তাঁদের অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাতায়াত করেন। উমামার প্যানেলে ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে প্রার্থী করা হয়েছে রাফিজ খানকে। রাফিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৈতালী বাস রুটের সাবেক সভাপতি। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁর পরিচিতি আছে। এটি অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে উমামার প্যানেলকে কিছুটা এগিয়ে রাখবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

উমামা ফাতেমা প্রচারে মনোযোগ দিয়েছেন। প্রচার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৬ আগস্ট মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে নির্মিত জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে ফুল দিয়েছেন। এর আগে শাহবাগে জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য।

উমামা ফাতেমা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে তাঁদের প্যানেলের প্রচারণা চলছে। পাশাপাশি বিভিন্ন হলসহ ক্যাম্পাসের সব প্রান্তে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন।

দেশের ভালো ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি দেশের ভিত্তি মজবুত করতে আমাদের যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে যোগ্য ও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে।
জিএস প্রার্থী আল সাদী ভূঁইয়া

স্লোগান ‘নয় দলীয়করণ, নয় বিরাজনীতিকরণ’

উমামা ফাতেমার প্যানেল থেকে ডাকসুর জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে প্রার্থী হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (ডুজা) সাবেক সভাপতি আল সাদী ভূঁইয়া। তিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হল সংসদে সাহিত্য সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হন। সাংবাদিকতাসহ নানা কর্মকাণ্ডের কারণে আল সাদী ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ।

এই প্যানেল থেকে সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রার্থী হওয়া জাহেদ আহমদ ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আলোচনায় আসা ‘গুরুবার আড্ডার’ নিয়মিত সদস্য ছিলেন জাহেদ।

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ থেকে পদত্যাগ করে উমামার প্যানেল থেকে ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা। তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী। রুপাইয়ার বিভাগের আরও পাঁচজন শিক্ষার্থী এই প্যানেলে প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন।

স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের প্রার্থীদের অধিকাংশই কখনো সরাসরি কোনো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের পদে ছিলেন না। প্যানেলের স্লোগান ঠিক করা হয়েছে ‘নয় দলীয়করণ, নয় বিরাজনীতিকরণ; পলিটিক্যালি কনশাস, একাডেমিক ক্যাম্পাস।’

এমন স্লোগান ঠিক করার কারণ জানতে চাইলে জিএস প্রার্থী আল সাদী ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের ভালো ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি দেশের ভিত্তি মজবুত করতে আমাদের যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে যোগ্য ও দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিরাজনীতিকরণ করা হলে দেশে অন্য কোনো অশুভ শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। তাই আমরা বিরাজনীতিকরণ চাই না। আবার দলীয়করণ হলে শিক্ষার্থীদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে। তাই সেটিও আমরা চাই না।’