গণসংবর্ধনায় আসা নেতা–কর্মীদের অভিবাদন জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পূর্বাচলের ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ের সংবর্ধনা মঞ্চ। গত বৃহস্পতিবারের ছবি
গণসংবর্ধনায় আসা নেতা–কর্মীদের অভিবাদন জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পূর্বাচলের ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ের সংবর্ধনা মঞ্চ। গত বৃহস্পতিবারের ছবি

তারেক রহমানের দেশে ফেরা

উজ্জীবিত বিএনপির লক্ষ্য এখন নির্বাচন

দীর্ঘদিন পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা এবং ঢাকায় তাঁর সংবর্ধনা সমাবেশে অভূতপূর্ব উপস্থিতিতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বেশ উজ্জীবিত। দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ঘিরে রাজধানীতে বিশাল গণজমায়েতের প্রভাব মাঠপর্যায়ে পড়ছে। বিশেষ করে এর প্রভাবে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে গণসংবর্ধনার প্রভাব আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়তে পারে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, তারেক রহমানের ফেরার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দলের প্রধান নেতৃত্বের বাংলাদেশে সরাসরি অনুপস্থিতিজনিত যে শূন্যতা তৃণমূলে অনুভূত হচ্ছিল, সেটিও কেটে গেছে। বরং তাঁরা ঢাকা থেকে উজ্জীবিত হয়ে এলাকায় ফিরেছেন। নেতা-কর্মীদের এই উদ্দীপনা ভোটের মাঠে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখবে—এমন প্রত্যাশা বিএনপির ভেতরে এখন জোরালো। এই বিশাল গণজমায়েতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরাও বেশ উচ্ছ্বসিত। ইতিমধ্যে প্রার্থীদের বেশির ভাগ যাঁর যাঁর নির্বাচনী এলাকায় ফিরে গেছেন।

এই প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ছিল অভূতপূর্ব।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

এদিকে সদ্য নির্বাসন থেকে ফেরা তারেক রহমান ভোটার হওয়ার পর মনোনয়নপত্র দাখিল করাসহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই নির্বাচনের প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেবেন। এরপর দলীয় এবং সমমনা প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে তাঁর যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র ওই তথ্য জানিয়ে আরও বলছে, এখনো ১৫টি আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা বাকি রয়েছে। আজ বা আগামীকালের মধ্যে এসব আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেওয়া হবে। এ কাজগুলো দ্রুত শেষ করেই ভোটের মাঠে নামতে চায় বিএনপি।

পূর্বাচল ৩০০ ফুটে গণসংবর্ধনাস্থলে বিএনপির নেতা কর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার সকাল আটটার দিকে

ওই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শিগগিরই তারেক রহমানের বগুড়া ও সিলেটে যাওয়ার কথা রয়েছে। তিনি সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরান (রহ.)–এর মাজার জিয়ারত করবেন। তাঁর শ্বশুরবাড়িও সিলেটে। আর বগুড়া তাঁর নির্বাচনী এলাকা। তিন দিনের জন্য তিনি বগুড়ায় যেতে পারেন বলে জানা গেছে। তবে সফরের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ জানা যায়নি।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র ওই তথ্য জানিয়ে আরও বলছে, এখনো ১৫টি আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা বাকি রয়েছে। আজ বা আগামীকালের মধ্যে এসব আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করে ঘোষণা দেওয়া হবে। এ কাজগুলো দ্রুত শেষ করেই ভোটের মাঠে নামতে চায় বিএনপি।

তারেক রহমান বগুড়া-৬ (সদর) আসন থেকে নির্বাচন করবেন। পাশের বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে তাঁর মা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্বাচন করার কথা। ইতিমধ্যে দুজনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।

২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। ২৮ ডিসেম্বর তারেক রহমান বগুড়ায় যেতে পারেন। ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের পর ৩০ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় ফিরবেন—এমন পরিকল্পনার কথা দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে। তারেক রহমান কয়েক দিন বগুড়ায় থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি ও প্রচারের বিষয়ে দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। তবে দলের অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, ২৮ ডিসেম্বর তারেক রহমান সিলেট সফরে যেতে পারেন। তবে সেটিও এখনো চূড়ান্ত নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.) -এর মাজার জিয়ারত করতে দ্রুত সিলেটে আসবেন। তবে তিনি কবে আসবেন, সেটা দল এখনো নিশ্চিত করেনি।

গত বৃহস্পতিবার তারেক রহমান লন্ডনে ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে দেশে ফেরেন। তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘিরে রাজধানী ঢাকায় লাখ লাখ নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব জমায়েত হয়। ঢাকার পূর্বাচলের ৩০০ ফুট এলাকায় অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা সমাবেশে সারা দেশ থেকে দলের মনোনীত প্রার্থীরা যোগ দেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকা থেকে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। সংবর্ধনা কর্মসূচি শেষে তাঁরা আবার এলাকায় ফিরে গেছেন।

বিএনপির নেতারা বলছেন, প্রায় দেড় যুগ পর তারেক রহমানের দেশে ফেরা এবং তাঁর সংবর্ধনা সমাবেশে অভূতপূর্ব উপস্থিতি একদিকে নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি করেছে, অন্যদিকে এই বিশাল গণজমায়েত ভোটের মাঠে সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রভাব তৈরি করছে। এখন সরাসরি নির্বাচনী এলাকায় তারেক রহমানের উপস্থিতি রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন দলের নেতারা। দেশে ফেরার পর গতকাল শুক্রবার তিনি তাঁর বাবা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করেন। এরপর তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশে রওনা দেন।

বাবার কবর জিয়ারত করে দোয়া পাঠ করেন তারেক রহমান। ২৬ ডিসেম্বর

আজ শনিবার তারেক রহমান প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরিফ ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করবেন। এরপর তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন করতে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে যাবেন। সেখান থেকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যাবেন। কার্যত তিন দিনের কর্মসূচির পর তিনি দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক, সাংগঠনিক বিষয় পর্যালোচনা এবং নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, প্রায় দেড় যুগ পর তারেক রহমানের দেশে ফেরা এবং তাঁর সংবর্ধনা সমাবেশে অভূতপূর্ব উপস্থিতি একদিকে নেতা-কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি করেছে, অন্যদিকে এই বিশাল গণজমায়েত ভোটের মাঠে সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রভাব তৈরি করছে।

কী সেই পরিকল্পনা তারেক রহমানের

বৃহস্পতিবারের গণসংবর্ধনায় ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান ফর দ্য পিপল, ফর দ্য কান্ট্রি’ বলে উক্তি করেন তারেক রহমান, যা ইতিমধ্যে সারা দেশে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। দেশের মানুষের জন্য, দেশের জন্য তাঁর সেই প্ল্যান (পরিকল্পনা) বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতাও চেয়েছেন তিনি। যদিও বক্তব্যের শুরুর দিকে ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বলে পরে ‘উই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বলেছেন তারেক রহমান। কিন্তু কী সেই পরিকল্পনা তাঁর।

বিএনপির নেতারা বলছেন, এই পরিকল্পনার লক্ষ্য রাষ্ট্র পরিচালনায় কাঠামোগত সংস্কার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনজীবনের মৌলিক সংকট মোকাবিলা। নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় একাধিক অনুষ্ঠানে ইতিমধ্যে তারেক রহমান জনকল্যাণকেন্দ্রিক আট দফা পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। এই পরিকল্পনায় সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করে স্বল্প ও বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, কৃষকদের জন্য কৃষি কার্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে সার-বীজ-সহায়তা সহজ করা এবং ন্যায্যমূল্যে ফসল বিক্রির নিশ্চয়তা। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে।

বিএনপির ভাষ্য, এসব দফা শুধু নির্বাচনী অঙ্গীকার নয়, বরং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা। নির্বাচনী মাঠে তারেক রহমানের এই পরিকল্পনা তারা ভোটারদের কাছে তুলে ধরবে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, এই পরিকল্পনার লক্ষ্য রাষ্ট্র পরিচালনায় কাঠামোগত সংস্কার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনজীবনের মৌলিক সংকট মোকাবিলা।

সব মিলিয়ে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বিএনপির ভেতরে নতুন করে গতি এনেছে। মাঠপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সক্রিয়তা বেড়েছে, ভোটের প্রচারেও নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন দলটির নজর নির্বাচনের দিকে। এই প্রত্যাবর্তন ভোটের মাঠে কী প্রভাব ফেলে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

১৭ বছর পর তারেক রহমানের দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি গতকাল ঢাকায় দলীয় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এই প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ছিল অভূতপূর্ব। দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন এবং আনন্দ-উচ্ছ্বাসে অংশ নিয়েছেন।