ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবন

ডাকসু নির্বাচন: বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী, ক্যাম্পাসে আলোচনা

ডাকসুতে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে হাসিবুল ইসলামকে প্রার্থী করেছিল গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ-সমর্থিত ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’। কিন্তু প্যানেল ঘোষণার তিন দিনের মাথায় ‘বিদ্রোহ’ করে বসেন হাসিবুল। তিনি সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মুখ্য সংগঠক হাসিবুল। সংগঠনের প্যানেল ত্যাগ করে কেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে হাসিবুল প্রথম আলোকে বলেন, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সবাই তাঁকে বলেছেন, এজিএস পদে নির্বাচন করলে তাঁর জেতার সম্ভাবনা বেশি। তাই তিনি এই পদে প্রার্থী হয়েছেন।

শুধু হাসিবুল নন, ডাকসুর এজিএস পদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আরও তিনজন নেতা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা হলেন তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী, সানজানা আফিফা (অদিতি) ও আশিকুর রহমান (জীম)। সব মিলিয়ে শুধু এজিএস পদেই নির্বাচন করছেন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের পাঁচজন নেতা। তাঁদের মধ্যে তাহমীদ সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক, সানজানা ও আশিকুর যুগ্ম সদস্যসচিব। আর সংগঠনটির প্যানেল থেকে এজিএস পদে প্রার্থী হয়েছেন আশরেফা খাতুন। তিনি সংগঠনটির কেন্দ্রীয় মুখপাত্র।

যেসব পদে একাধিক প্রার্থী রয়েছে, সেসব পদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ভোট ভাগ হয়ে যেতে পারে, এমন আলোচনা ক্যাম্পাসে রয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা জয়ের ব্যাপারেও আশাবাদী। তবে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, ভোটে এসব বিষয় তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের একাংশের উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারিতে আত্মপ্রকাশ করে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। এবারের ডাকসু নির্বাচনে তাদের প্যানেলের নাম বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ। কিন্তু প্যানেলের বাইরে এজিএস পদে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সংগঠনটির চার নেতা। একইভাবে সম্পাদকীয় পদেও সংগঠনটির অন্তত চারজন নেতা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া সদস্য পদে সংগঠনের প্যানেলের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করছেন তিনজন।

যেসব পদে একাধিক প্রার্থী রয়েছে, সেসব পদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ভোট ভাগ হয়ে যেতে পারে, এমন আলোচনা ক্যাম্পাসে রয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীরা জয়ের ব্যাপারেও আশাবাদী। তবে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, ভোটে এসব বিষয় তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।

একাধিক প্রার্থী কেন

ডাকসুতে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের প্যানেলে ভিপি পদে আব্দুল কাদের ও জিএস পদে আবু বাকের মজুমদারের নাম অনেক আগে থেকেই চূড়ান্ত ছিল। আর এজিএস পদে নির্বাচনের জন্য আলোচনায় ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব জাহিদ আহসান, কেন্দ্রীয় নেতা তাহমীদ আল মুদ্দাসসীর চৌধুরী ও হাসিবুল ইসলাম। একপর্যায়ে এজিএস পদের জন্য তাহমীদের নাম চূড়ান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত আশরেফা খাতুনকে মনোনয়ন দেয় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ।

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের প্যানেল ঘোষণার পর এজিএস পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন তাহমীদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংগঠনের প্যানেল গঠনের প্রক্রিয়ার সময় সিদ্ধান্ত হয়েছিল কেউ চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব তৈরি হয়নি। আমরা যে চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি, প্রত্যেকের ভোটব্যাংক আলাদা। বিষয়টিকে আমাদের কৌশলগত অবস্থান হিসেবে দেখা যেতে পারে।’

এজিএস পদে নির্বাচন করা আরেকজন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী সানজানা আফিফা বলেন, তিনি মনোয়নপত্র কেনার শেষ দিন পর্যন্ত সংগঠনের প্যানেল দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কারণ দুটি। প্রথমত, মনোনয়নপত্র কেনার সর্বশেষ দিন পর্যন্ত সংগঠন কোনো পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেনি বা দেয়নি; যাঁরা প্যানেলে আসছেন না, তাঁদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে, সে ধরনের কোনো কাঠামোও সংগঠন দেখাতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, প্যানেলের বিষয়ে সংগঠনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাইরের বেশ কিছু মানুষের প্রভাব কাজ করছিল।

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদে খুবই অল্প মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয় না। মিটিংয়ে শুধু সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আসে মন্ত্রিপাড়া থেকে। সে জন্য সাংগঠনিক ভিত্তিটা খুবই দুর্বল, যা ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও প্রকট হয়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল হক

ডাকসুতে পদের ক্রম অনুযায়ী, ভিপি–জিএস–এজিএসের পরের পদটি হলো মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক। এই পদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের যুগ্ম সদস্যসচিব আবদুল্লাহ সালেহীন ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সাঈদ প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা দুজনই ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।

ডাকসুর স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের প্রার্থী সাব্বির আহমেদ। এই পদে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়েছেন সংগঠনের যুগ্ম সদস্যসচিব শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন।

হল সংসদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্যানেল ঘোষণা করেনি। তবে তাঁদের অন্তত ৫৭ জন নেতা বিভিন্ন হল সংসদে প্রার্থী হয়েছেন। এর বাইরে কিছু নেতা সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে হল সংসদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। যেমন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদে যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল সংসদের ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মুক্তসেন মোক্তার। সংগঠন থেকে পদত্যাগ করে মাস্টারদা সূর্য সেন হল সংসদের ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আজিজুল হক।

ওই দুজনের মধ্যে আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদে খুবই অল্প মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয় না। মিটিংয়ে শুধু সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আসে মন্ত্রিপাড়া থেকে। সে জন্য সাংগঠনিক ভিত্তিটা খুবই দুর্বল, যা ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও প্রকট হয়েছে।’

‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী এত বেশি কেন, সে বিষয়ে জানতে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের অন্তত ছয়জন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, নতুন ছাত্রসংগঠন হওয়ায় এখনো তাঁদের সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি হয়নি। কেউ কারও নির্দেশনা মানতে চান না। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ভূমিকার কারণে অনেকেই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনে করেন। এ নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতাও রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ আরোপে ব্যর্থ হয়ে পরে সংগঠনের পক্ষ থেকে ডাকসুতে প্রার্থিতার বিষয়টি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তবে যাঁরা পদত্যাগ করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ গোপনে অন্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের প্যানেলে নির্বাচন করতে পারেন, এমন আলোচনা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ নামে আলাদা প্যানেল করে ভিপি পদে নির্বাচন করছেন। গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ থেকে পদত্যাগ করে উমামার প্যানেলে ক্যারিয়ার উন্নয়ন সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা।

এ ছাড়া মাহিন সরকারের নেতৃত্বে সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ নামের একটি পৃথক প্যানেল হয়েছে ডাকসুতে। মাহিন সরকারও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক। তিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব ছিলেন। দলের ‘অনুমতি না নিয়ে’ ডাকসুতে প্যানেল দেওয়ার ঘটনায় তাঁকে বহিষ্কার করেছে এনসিপি। এরপরও মাহিনের প্যানেল থেকে সদস্যপদে নির্বাচন করছেন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতা সাব্বির উদ্দিন ও বায়েজিদ হাসান।

অবশ্য গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের দুজন নেতা জানান, মাহিন সরকারের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছিল। কিন্তু তিনি শীর্ষ একটি পদে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলেন। পরে তিনি আলাদা প্যানেল ঘোষণা করেন।

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের অনেক নেতার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বা অন্য প্যানেলের প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে ডাকসুতে এই প্যানেলের জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক পদে সংগঠনের একাধিক প্রার্থী থাকা নির্বাচনী কৌশল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যাঁরা নির্বাচন করছেন, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।’