শেখ হাসিনা
শেখ হাসিনা

জনগণের সম্পত্তির প্রতি শেখ হাসিনার ছিল লোভাতুর দৃষ্টি: আদালত

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে নিয়মানুযায়ী প্লট বরাদ্দের কোনো আবেদন না করলেও প্লটের দখল বুঝে পেতে ঠিকই আবেদন করেছিলেন। এতে বোঝা যায়, সম্পদের প্রতি লোভ ছিল তাঁর।

শেখ হাসিনা ও তাঁর দুই সন্তানের বিরুদ্ধে পূর্বাচলের প্লট দুর্নীতির মামলায় রায় ঘোষণার সময় এ কথা বলেছেন ঢাকার বিশেষ জজ-৫ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন। আজ বৃহস্পতিবার তিনি এ রায় দেন।

বিচারক বলেন, ‘শেখ হাসিনা নিজে প্লট নেওয়ার পর তাঁর ছেলে ও মেয়ের নামেও বরাদ্দ নেন। এরপর তাঁর বোন শেখ রেহানা, বোনের মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের নামেও বরাদ্দ নিয়েছেন। জনগণের সম্পত্তির প্রতি ওনার লোভাতুর দৃষ্টি পড়েছে। উনি চারবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপরও জনগণের সম্পদ থেকে লোভ সামলাতে পারেননি।’

প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির পৃথক ৩ মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ বছর করে ২১ বছর কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে। তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দেওয়া হয়েছে ৫ বছর করে কারাদণ্ড। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ও তাঁর তিন সন্তানকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচার হয়েছে।

রায়ে শাস্তি ঘোষণার আগে বিচারক এ মামলার পটভূমি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্লট দুর্নীতির বিষয়টি সাংবাদিকদের মাধ্যমেই উঠে আসে। মিডিয়া যে চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে, আমরা এ মামলার মাধ্যমে দেখলাম। আপনাদের রিপোর্ট না থাকলে দুদক কখনোই এ মামলা করত না। পত্রিকা রিপোর্টের আলোকেই দুদক পদক্ষেপ নিয়েছে।’

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুদক রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে তাঁর পরিবারের ছয় সদস্যের নামে ছয়টি প্লট (প্রতিটি ১০ কাটা আয়তনের) নিয়ে তদন্তে নামে। তাতে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর এ বছরের শুরুতে ছয়টি মামলা করে।

শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পূর্বাচলের নতুন শহর প্রকল্পে নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে ছয়টি প্লট বরাদ্দ নেন। ঢাকা শহরে তাঁদের নামে সম্পত্তি থাকার পরও তা গোপন করে এই প্লট বরাদ্দ নেওয়া হয়।

তাতে অভিযোগ করা হয়, শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলের নতুন শহর প্রকল্পে নিজের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নামে ছয়টি প্লট বরাদ্দ নেন। ঢাকা শহরে তাঁদের বসবাসের সম্পত্তি থাকলেও তা গোপন করে এই প্লট বরাদ্দ নেওয়া হয়। পাশাপাশি প্লট পাওয়ার আবেদনের সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও নিয়ম ভেঙে তাঁদের এগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়।

ছয়টি মামলার তিনটি হয়েছে শেখ রেহানা, তাঁর মেয়ে আজমিনা ও ছেলে রাদওয়ান মুজিবের প্লট নিয়ে। সব কটি মামলাতেই শেখ হাসিনা আসামি। এগুলোর মধ্যে শেখ হাসিনা ও তাঁর ছেলে-মেয়ের প্লট–সংক্রান্ত দুর্নীতির মামলাটির রায় আজ হলো।

বিচারক প্রথমে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় দেন। তিনি বলেন, রাজউকের ক্ষেত্রে দুই ধরনের ক্যাটাগরিতে প্লট দেওয়া হয়। একটা জেনারেল, আরেকটা স্পেশাল। এ মামলার বিষয়টি স্পেশাল ক্যাটাগরি।

শেখ হাসিনা

দুদক আইনের পঞ্চম ধারার কথা উল্লেখ করে বিচারক বলেন, ‘যদি কেউ আবেদন না করে, তাহলে সে প্লট পাবেই না। কিন্তু আমরা দেখেছি, এ প্লটের কার্যক্রম শুরু হয়েছে কোনো ধরনের আবেদন ছাড়াই।’

বিচারক বলেন, ২০২২ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ উদ্দিন আহমেদ আইনটি না মেনে শেখ হাসিনার প্লট বরাদ্দ দেওয়ার অনুমোদন দেন। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহিদ উল্লাহ খন্দকার, ওয়াছি উদ্দিনসহ অন্যরাও প্লট দেওয়ার জন্য রাজউককে সুপারিশ করেন। ওই বছরের ১৯ জুলাই রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে সুপারিশপত্র পাঠানোর পর তা রাজউকের বোর্ড সভায় নিয়ম না মেনেই অনুমোদন হয়।

রায়ের সময় বলা হয়, ২০২২ সালের ১৮ জুলাই তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ উদ্দিন আহমেদ আইনটি না মেনে শেখ হাসিনার প্লট বরাদ্দ দেওয়ার অনুমোদন দেন। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্যরাও প্লট দেওয়ার জন্য রাজউককে সুপারিশ করেন। রাজউকের বোর্ড সভায় নিয়ম না মেনেই অনুমোদন হয়।

বিচারক বলেন, ‘বোর্ড সভায় রাজউকের চেয়ারম্যানসহ সদস্যরা থাকেন। তাঁদের একজন খুরশীদ আলম (আসামি) আজ আমাদের মাঝে আছেন। সেখানে তাঁরা দেখেছেন, কোনো আবেদন নেই। কিন্তু তাঁরা আইনের তোয়াক্কা না করে অনুমোদন করেন, প্রধানমন্ত্রীকে প্লট দেওয়া হোক। ২৭ জুলাই রাজউক থেকে পত্র ইস্যু করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, প্লটের জন্য আপনাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।’

প্লট বরাদ্দ দেওয়ার আগে আবেদনকারীর কাছ থেকে হলফনামা নেওয়া হয় এই বলে যে তার নামে রাজউক অথবা অন্য কোনো সরকারি বা আধা সরকারি প্রকল্পে কোনো প্লট নেই। কিন্তু সেই হলফনামা নোটারি পাবলিক দ্বারা সত্যায়িত করা হয়নি। আবার হলফনামায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাঁর স্বামীর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে ১৯৭৩ সালে প্লট বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেননি।

বিচারক বলেন, ‘তিনি উল্লেখ করেছেন, আমার নামে ঢাকা শহরে কোনো প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এটা একটা প্রতারণা। ওনার হলফনামাটি কেউ গ্রহণ করবে কি না, আমার জানা নেই। কারণ, আইন অনুযায়ী নোটারিটি সত্যায়িত হয়নি। সেখানে কারও কোনো স্বাক্ষর নেই। এখানে নিয়ম মানা হয়নি। এগুলো উপেক্ষা করে হলফনামাকে চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করে রাজউক ৩ আগস্ট (২০২২ সাল) শেখ হাসিনাকে প্লট বরাদ্দ দেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি প্লট বুঝে পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। এখন তিনি প্লট বুঝে নেয়ার জন্য আবেদন করেছেন।’

আমরা বুঝেছি, ওনার সম্পদের প্রতি লোভ আছে। ওনাকে যখন বরাদ্দ দেওয়া হয়, উনি তখন সেটা ছুড়ে ফেলতে পারতেন। বলতে পারতেন, ‘আমি তো আবেদন করিনি।’ ওনাদের তো আইনজীবী রয়েছেন। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ ছিল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক

প্লট বুঝে নেওয়ার আবেদনের প্রসঙ্গ ধরে বিচারক বলেন, ‘দ্বিতীয়বার দেওয়ার মাধ্যমে আমরা বুঝেছি, ওনার সম্পদের প্রতি লোভ আছে। ভালোবাসা আছে। ওনাকে যখন বরাদ্দ দেওয়া হয়, উনি তখন সেটা ছুড়ে ফেলতে পারতেন। বলতে পারতেন, “আমি তো আবেদন করিনি।” ওনাদের তো আইনজীবী রয়েছেন। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ ছিল।’

এরপর ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনাকে পূর্বাচলের নতুন শহরের ৯ নম্বর প্লটটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। রায়ে উল্লেখ করে বিচারক বলেন, ‘এখানে রাজউক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অন্যায় করেছে। উনি যদি এটা না পেতেন, তাহলে এই দেশের খেটে খাওয়া কোনো মানুষ বা যোগ্য কোনো মানুষ সেটা পেতেন।’

দণ্ডবিধির ৪২০ ধারার পাশাপাশি দুদক আইনের ৫ (২) ধারায়ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে জানিয়ে বিচারক বলেন, ‘সেখানে (দুদক আইন) বলা হয়েছে, কেউ যদি ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য আইনকে না মানে, তাহলে সেটি শাস্তিযোগ্য হবে। এই দুটো প্রমাণিত হওয়ায় ওনাকে সাজা দেওয়া যায়৷ সে জন্য ওনাকে সাত বছরের সাজা দেওয়া হলো।’