ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি

বছরজুড়ে আলোচনায় ওসমান হাদি

ভক্তরা তাঁর সাহসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কাছে তিনি চক্ষুশূল; আবার স্লোগানে ভব্যতার সীমা লঙ্ঘনের কারণে তাঁর নিন্দাও চলে সমানতালে। এসব মিলিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে বছরজুড়ে আলোচিত চরিত্র শরিফ ওসমান হাদি। দুর্বৃত্তের গুলিবর্ষণের শিকার হয়ে এখন হাসপাতালে ‘লাইফ সাপোর্টে’ রয়েছেন তিনি।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন আজ শুক্রবার রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় ওসমান হাদিকে গুলি করে মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা। এই এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রচার চালাচ্ছিলেন এই যুবক।

জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা এক মাস আগেই জানিয়েছিলেন হাদি। তাঁর ওপর হামলাকারীরা এখনো চিহ্নিত না হলেও এটা নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অংশ মনে করছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান হাদি। আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে

হাদি যেভাবে আলোচনায়

দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠির নলছিটি থেকে উঠে আসা হাদিকে কোনো রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত থাকতে দেখা যায়নি। মাদ্রাসার শিক্ষকের ছেলে হাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে পড়াশোনা করেন নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করার পর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন তিনি।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে আলোচনায় আসেন হাদি। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোয় ডাক পেতে থাকেন। প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিতেন তিনি। পরে নেন আহ্বায়কের দায়িত্ব।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে আলোচনায় আসেন হাদি। সাংস্কৃতিক এই প্ল্যাটফর্ম তাদের লক্ষ্য ঠিক করে—‘সমস্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ’। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়েই একটি সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তোলেন তিনি।

প্রতিষ্ঠার পরপরই জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি ও শহীদ–আহত ব্যক্তিদের স্বীকৃতি এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি তুলে শাহবাগে সমাবেশ আয়োজন শুরু করেন হাদি। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোয় ডাক পেতে থাকেন। প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিতেন তিনি। পরে নেন আহ্বায়কের দায়িত্ব।

ভারতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনায় প্রতিবাদে ওসমান হাদির নেতৃত্বে গত বছরের ডিসেম্বরে মিছিল নিয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে স্মারকলিপি দেয় ইনকিলাব মঞ্চ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে যোগ দেন ওসমান হাদি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতেও সরব হয়ে ওঠেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষে তাঁকে কথা বলতে শোনা যায়।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে মাঠে তৎপর হাদি। বিশেষ করে ভোররাতে মসজিদে ভোট চাওয়ার ছবি ও ভিডিও তিনি নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। বাতাসা–মুড়ি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারও চালান।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন হাদি। গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের ওপর হামলা হলে কঠোর ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানান তিনি। তখন তিনি কিছু অশোভন শব্দও ব্যবহার করেছিলেন, যা পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

গত নভেম্বরে ওসমান হাদি নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে দাবি করেন, দেশি–বিদেশি অন্তত ৩০টি ফোন নম্বর থেকে তাঁকে ফোন ও মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে; তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া, তাঁর মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকেরা তাঁকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখছে। তবে ‘জীবননাশের আশঙ্কা’ সত্ত্বেও তিনি ‘ইনসাফের লড়াই’ থেকে পিছিয়ে যাবেন না।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে গত বছর শাহবাগে সমাবেশে ওসমান হাদি

নির্বাচনী লড়াইয়ে

জুলাই অভ্যুত্থানের পর জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন ওসমান হাদি। প্ল্যাটফর্মটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে ওই প্ল্যাটফর্মের বেশির ভাগ সদস্য পরে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) যোগ দিলেও হাদি দলটিতে যাননি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসনে (মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর থানা) স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরেই মাঠে তৎপর হাদি। বিশেষ করে ভোররাতে মসজিদে ভোট চাওয়ার ছবি ও ভিডিও তিনি নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। বাতাসা–মুড়ি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারও চালান।

ভোটের প্রচারে ঢাকা–৮ আসনের বিভিন্ন স্থানে বোর্ড বসিয়েছেন ওসমান হাদি, সেখানে ভোটারদের তাঁদের প্রত্যাশা প্রকাশের সুযোগ রয়েছে

ভোটার ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে নির্বাচনে অনুদান নেওয়ার ছবি–ভিডিও শেয়ার দিচ্ছেন হাদি। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী কাজে ব্যয়ের জন্য কত টাকা অনুদান পেয়েছেন, তা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেনও তিনি।

ঢাকা–৮ আসন থেকে এনসিপির হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ২০ নভেম্বর মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন রিকশাচালক মো. সুজন। তিনি জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের ‘আইকনিক স্যালুট’ দিয়ে আলোচিত হন। তাঁর সেই স্যালুটের ছবি জাতীয় পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। ওসমান হাদি এই রিকশাচালকের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের ঘটনায় স্বাগত জানান। আলোচনা ওঠে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি মো. আবু সাদিক কায়েম ঢাকা–৮ আসন থেকে ভোট করতে পারেন। তাঁকেও স্বাগত জানান ওসমান হাদি।

ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বেশ আগে থেকে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিলেন ওসমান হাদি

সম্প্রতি বরিশালের বাবুগঞ্জে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদকে হেনস্তা করা হয়। একটি সেতুর নির্মাণকাজ পাওয়া ঠিকাদারের কাছে ‘স্থানীয়রা চাঁদা দাবি করেছে’—গণমাধ্যমে এমন বক্তব্য দেওয়ার পর তোপের মুখে পড়েন ফুয়াদ। এ ঘটনায় ফুয়াদের পক্ষে অবস্থান নেন ওসমান হাদি এবং বরিশালে গিয়ে ফুয়াদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেবেন বলে জানান তিনি।

গত ১৫ নভেম্বর মতিঝিল এজিবি কলোনি এলাকায় প্রচারে গেলে তাঁর ওপর ময়লা পানি ফেলার অভিযোগ করেন ওসমান হাদি। ওই ঘটনার ছবি–ভিডিও প্রচারিত হয়। এরপর ফেসবুকের একটি ভিডিওতে হাদিকে বলতে শোনা যায়, তাঁর গায়ে তিনবার ময়লা পানি ছোড়া হয়েছে। তিনি প্রতিপক্ষের উদ্দেশে বলেন, আরও ময়লা পানি মারেন। অসুবিধা নেই।

ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সবাই নিন্দা ও উদ্বেগ জানাচ্ছেন। তাঁর সমালোচকদের কেউ কেউ বলছেন, তাঁর সঙ্গে মতের অমিল থাকতে পারে। তাই বলে গুলি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।