
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুর দায় থেকে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা কখনো মুক্তি পাবেন না বলে মন্তব্য করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া দেশ-বিদেশের কোনো অপশক্তির সামনে কখনো মাথা নত করেননি। যারা তাঁকে (খালেদা জিয়া) জেলে পাঠিয়েছে, যারা তাঁকে গৃহহীন করেছে, তারা রান্না করা খাবার খেতে পারেনি, পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আজ বুধবার দুপুরে খালেদা জিয়ার জানাজার আগে নজরুল ইসলাম খান এ কথা বলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ফ্যাসিবাদী হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে দুই বছরের বেশি সময় অন্ধকার কারাগারে আবদ্ধ থাকার সময় উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে দেশনেত্রী দারুণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুরো দেশবাসী সাক্ষী, পায়ে হেঁটে তিনি কারাগারে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু নির্জন কারাগার থেকে তিনি বের হলেন চরম অসুস্থতা নিয়ে। দেশ-বিদেশের চিকিৎসকদের মতে, পরবর্তী সময়ে গৃহবন্দীতে চার বছর তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ না দেওয়ার কারণেই তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো এই অপরাজেয় নেত্রীর। তাই এই মৃত্যুর দায় থেকে ফ্যাসিবাদী হাসিনা কখনো মুক্তি পাবে না।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং দেশের স্বার্থে অনমনীয়তা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে ব্যক্তিগত শত্রু হিসেবে গণ্য করা শুরু করে বলে উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা, স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, এমনকি তথাকথিত ১/১১ সরকারের সময়ও দেশনেত্রীকে কারারুদ্ধ করা হয়। ফ্যাসিবাদী হাসিনা স্রেফ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দেশনেত্রীকে তাঁর শহীদ স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে উৎখাত করেন এবং মিথ্যা অভিযোগে ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তবু আধিপত্যবাদী অপরাজনীতির সঙ্গে তিনি আপস করেননি; আপস করেননি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা ভোটাধিকারের প্রশ্নে। ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ফ্যাসিস্ট শাসনবিরোধী লড়াইয়ের অনন্ত অনুপ্রেরণা।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আজ দেশনেত্রী সব অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে লক্ষকোটি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আজকে জানাজায় আমাদের সামনে আছেন। অন্যদিকে যারা তাঁকে জেলে পাঠিয়েছে, যারা তাঁকে গৃহহীন করেছে, তাঁরা রান্না করা খাবার খেতে পারেনি, পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। মাথার ওপর তাদের ঝুলছে মৃত্যু পরোয়ানা। এরশাদকে ভোগ করতে হয়েছে দীর্ঘ কারাবাস, ১/১১ সরকারের প্রধান ব্যক্তিরাও দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে।’
দল এবং দলীয় নেতাদের মনোবল অটুট রাখার লক্ষ্যে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন বলেও উল্লেখ করেন নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের ক্লান্তিহীন পথচলা। ক্রমে দলের প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী হয়েও দলের গঠনতন্ত্র সমুন্নত রেখেও তিনি দলের ভাইস চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন, তারপর দলীয় কাউন্সিলে নির্বাচিত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ৪১ বছরই তিনি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলকে সুসংগঠিত করেছেন, শক্তিশালী করেছেন।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, দীর্ঘ ৯ বছর স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করে ১৯৯১ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন তিনি। জাতির কাছে তিনি পান ‘আপসহীন দেশনেত্রী’র মর্যাদা। দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় চির আপসহীন দেশনেত্রী দেশ-বিদেশের কোনো অপশক্তির সামনে কখনো মাথা নত করেননি। কোনো প্রলোভন, কোনো ষড়যন্ত্র বা হুমকি তাঁকে তাঁর জীবনের শেষ অবধি আপসের পথ বেছে নিতে বাধ্য করতে পারেনি। তিনি বরাবর থেকে গেছেন দেশের মানুষের পাশে।
খালেদা জিয়া বলতেন ‘বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই’ উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, জনগণের কল্যাণে গ্রহণ করেছেন একের পর এক যুগান্তকারী কর্মসূচি। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনে তাঁর সাফল্য বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনেছিল ‘ইমার্জিং টাইগার’ হিসেবে।
জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনবার উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে একজন ব্যক্তি যতটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, তিনি তা করেছেন। নির্বাচনে পাঁচটি করে এবং শুধু ২০০৮ সালে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটি আসনেই বিজয়ী হয়েছেন তিনি। জনগণের প্রকৃত সমর্থনে এবং বিপুল ব্যবধানে নির্বাচনে পরাজয়ের গ্লানি তাঁকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে বারবার। জনপ্রিয়তার এমন দৃষ্টান্ত শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, গণতন্ত্রকে ভালোবেসে তিনি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। দায়িত্ব পেয়ে গণতন্ত্রকে কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলেই দেশ-বিদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ তাঁকে ‘গণতন্ত্রের মাতা’ বলে সম্মানিত করেছেন। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে তাঁর গৃহীত কর্মসূচি ছিল অসংখ্য। নারীশিক্ষার প্রসারে উপবৃত্তি প্রথা ও ‘শিক্ষার জন্য খাদ্য’ কর্মসূচি এবং মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবাসীদের কল্যাণের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দুই শিশুপুত্রসহ ১৯৭১ সালের ২ জুলাই থেকে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায় কাটিয়েছেন। স্বামী স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর এবং ফোর্সেস কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর ফলস্বরূপ খালেদা জিয়া তাঁর দুই শিশুপুত্রসহ ছিলেন পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারের অবদান এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, দলমত–নির্বিশেষে পুরো দেশবাসীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দোয়া নিয়ে খালেদা জিয়া বিদায় নিচ্ছেন। পেছনে রেখে গেলেন এক মহীয়সী নারী, এক সংগ্রামী রাজনীতিবিদ, এক দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের অনন্য কর্মজীবনের উদাহরণ; যা এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্য।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘দেশনেত্রী খালেদা জিয়া বলতেন, “দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। বাংলাদেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এ দেশের মাটি ও মানুষ আমার সবকিছু।” এই দেশের মাটিতেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আজ এই দেশের মাটিতেই তাঁর শহীদ স্বামীর পাশে তিনি শায়িত হবেন চিরদিনের জন্য। ইনশা আল্লাহ, আমরা জনাব তারেক রহমানের নেতৃত্বে এগিয়ে যাব। দেশনেত্রীর মতোই গণতন্ত্র, শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে জনগণের কল্যাণে লক্ষ্য স্থির রেখে। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।’
প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, রাজনৈতিক নেতারা, তিন বাহিনীর প্রধানসহ কর্মকর্তাদের উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। এ ছাড়া তিনি সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান।