জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নমূলক গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান হয়েছে। হল দখল ও আধিপত্যের রাজনীতি এখন বন্ধ আছে। কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মসূচিতে যাওয়া এখন আর শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যাকে কেন্দ্র করে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি সাজানোর চেষ্টা করছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা এই পরিবর্তনগুলো টেকসই রূপ পাবে, ছাত্ররাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরবে, আসবে গুণগত পরিবর্তন, শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে—এসবই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা নিয়েই আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন।
ডাকসু প্রতিষ্ঠার ১০০ বছরের মাথায় এর ৩৮তম নির্বাচন আজ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বেশির ভাগ সময় ডাকসুর নির্বাচন হয়েছে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদগুলো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনা ও অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন এবং নানা ধরনের প্রকাশনা বের করার কাজই বেশি করেছে। ষাটের দশকেও এসব হয়েছে।
তবে ষাটের দশকে শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ডাকসু ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক ভূমিকাই বড় হয়ে দেখা দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব তৈরিতে ডাকসুর ভূমিকা ছিল। যদিও স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে সবচেয়ে কম, মাত্র সাতবার।
প্রথমবারের মতো হলের বাইরে ভোট
২০১৯ সালে ডাকসু ও হল সংসদের সর্বশেষ নির্বাচনের আগে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ (এখন নিষিদ্ধ) ছাড়া অন্য সব প্যানেলের পক্ষ থেকে আবাসিক হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি তোলা হয়েছিল। কারণ, হলগুলোতে তখন ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকায় ভোট প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার প্রশাসন এই আশঙ্কাকে আমলে না নিয়ে হলেই ভোট গ্রহণ করে। সেই নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এবার ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবারই প্রথম আবাসিক হলের বাইরে ডাকসু ও হল সংসদের ভোট গ্রহণ হচ্ছে। ক্যাম্পাসের নির্ধারিত ৮টি কেন্দ্রে (৮১০টি বুথ) শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন। কার্জন হল কেন্দ্রে ভোট দেবেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও অমর একুশে হলের শিক্ষার্থীরা (৫ হাজার ৭৭ ভোট)। শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রটি নির্ধারণ করা হয়েছে জগন্নাথ হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থীদের জন্য (৪ হাজার ৮৫৩ ভোট)। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ভোট দেবেন রোকেয়া হলের ছাত্রীরা (৫ হাজার ৬৬৫ ভোট)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব কেন্দ্রে ভোট দেবেন বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের শিক্ষার্থীরা (৪ হাজার ৭৫৫ ভোট)। স্যার এ এফ রহমান হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থীরা ভোট দেবেন সিনেট ভবন কেন্দ্রে (৪ হাজার ৮৩০ ভোট)।
সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভোট দেবেন উদয়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে মাস্টারদা সূর্য সেন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল ও কবি জসীমউদ্দীন হলের মোট ৬ হাজার ১৫৫ শিক্ষার্থী ভোট দেবেন। ভূতত্ত্ব বিভাগ কেন্দ্রে ভোট দেবেন কবি সুফিয়া কামাল হলের ৪ হাজার ৪৪৩ জন ছাত্রী। আর ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে শামসুন নাহার হলের ৪ হাজার ৯৬ জন ছাত্রীর ভোটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
আজ সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে। তবে চারটার মধ্যে যাঁরা ভোটকেন্দ্রের আঙিনায় প্রবেশ করবেন, যত সময় লাগুক, তাঁরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। ভোট গণনা শেষে আজ রাতেই ফল ঘোষণা হবে।
আজ ডাকসু নির্বাচনে বিএনসিসি, রোভার ও রেঞ্জাররা ভোটারদের লাইন ম্যানেজমেন্টে (ব্যবস্থাপনা) ও ভোটকেন্দ্রে থাকবেন। এরপর থাকবেন প্রক্টরিয়াল বডি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা। নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তার জন্য টিএসসি এলাকায় পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে এলইডি স্ক্রিনের মাধ্যমে ভোট গণনা সরাসরি দেখানো হবে।
গতকাল সোমবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এক ভিডিও বার্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান শিক্ষার্থীদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
গতবার ও এবার
গতবারের (২০১৯) নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হয়েছিল সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত (ছয় ঘণ্টা)। ভোটারের সংখ্যা এবার কিছুটা কম হলেও প্রার্থীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে বেশি। গতবার মোট ভোটার ছিলেন ৪৩ হাজার ২৫৬ জন, যার মধ্যে ১৬ হাজার ৩১২ জন ছিলেন ছাত্রী। এবার ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্র ২০ হাজার ৯১৫, ছাত্রী ১৮ হাজার ৯৫৯ জন।
২০১৯ সালে ডাকসুতে ২৫ পদে প্রার্থী হয়েছিলেন ২২৯ জন, এবার ২৮ পদে প্রার্থী ৪৭১। ১৮টি হল সংসদে ১৩টি করে মোট ২৩৪ পদে গত নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ৫০৯ জন, এবার এই সংখ্যা ১ হাজার ৩৫।
এবারের নির্বাচনে ডাকসুর ৪৭১ প্রার্থীর মধ্যে ছাত্রী ৬২ জন (মোট প্রার্থীর ১৩ শতাংশ)। আর পাঁচ ছাত্রী হল সংসদে ৬৫টি পদে প্রার্থী হয়েছেন ১৮৫ জন। ডাকসুর প্রার্থীদের মধ্যে ১৮ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী, যা মোট প্রার্থীর মাত্র ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। হল সংসদের ক্ষেত্রে জগন্নাথ হলে ১৩ পদের বিপরীতে প্রার্থী হয়েছেন ৫৫ জন। আর ছাত্রীদের পাঁচ হল সংসদে ১৮৫ প্রার্থীর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আছেন ১৪ জন।
এবার ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে ছাত্রীদের ভোট বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া জগন্নাথ হলে সংযুক্ত ২ হাজার ২২২ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্র এবং পাঁচ ছাত্রী হলে থাকা দেড় হাজারের বেশি সংখ্যালঘু ছাত্রী ভোটারও ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারেন। তাঁদের ভোট মোট ভোটের ১০ শতাংশ।
গতবারের নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটার হওয়ার বয়সসীমা ছিল ৩০ বছর আর এবার বয়সসীমা তুলে নেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ না থাকায় গতবারের নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কোনো প্যানেল ছিল না। এবার নিষিদ্ধ থাকায় ছাত্রলীগের কোনো প্যানেল নেই। গতবার নির্বাচনে প্যানেল ছিল ১৩টি, এবার প্রায় ১০টি। এবার ডাকসুর শীর্ষ তিন পদে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ-সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ, উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য এবং বামপন্থী সাত ছাত্রসংগঠনের সমর্থিত প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের প্রার্থীদের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। তবে ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেনও লড়াইয়ে থাকবেন, এমন আলোচনা ক্যাম্পাসে আছে।
গতবারের নির্বাচন ঘিরে প্রার্থী ও ভোটারদের চাপ প্রয়োগের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, এবার সে ধরনের অভিযোগ এখনো নেই। গতবার গণরুমগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকায় ছাত্রলীগ নির্বাচনে সুবিধা পেয়েছে, এবার কারও এমন সুবিধা নেই। প্রচারে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনাও এবার তুলনামূলক কম। এবার নতুন সংযোজন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে ডাকসুর প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচনী বিতর্কের আয়োজন।
গত কয়েক দিনে ক্যাম্পাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা মনে করেন, জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোকে টেকসই ও স্থায়ী করতে ডাকসু নির্বাচন ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ জন্য নিয়মিত নির্বাচন হতে হবে।
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। ডাকসুতে একটা মডেল তৈরি হলে সেটি সারা দেশ অনুসরণ করতে পারবে।