সিয়াম সাধনার মাস

প্রসঙ্গ কোরআন

কোরআন মানে পাঠ, পঠিত, পাঠযোগ্য, পঠনীয়, পঠিতব্য। কিরাত মানে পাঠ, আবৃত্তি, বিবৃতি। তিলাওয়াত মানে অধ্যয়ন, উপস্থাপন, পরিবেশন। পবিত্র কোরআন কোনো সাধারণ সাহিত্যপত্র নয়; তবে সাহিত্য মানোত্তীর্ণ। আল কোরআন কোনো সাধারণ ইতিহাসগ্রন্থ নয়; তবে এতে রয়েছে নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণ। কোরআন হাকিম কোনো সাধারণ বিজ্ঞান বই নয়; তবে এতে রয়েছে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও তত্ত্ব। কোরআন মজিদ কোনো সাধারণ ধর্মগ্রন্থ নয়; এটি সব ধর্মের সার নির্যাস। কোরআন আজিজ কোনো গল্পগ্রন্থ নয়; তবে এতে আছে প্রচুর শিক্ষণীয় সত্য কাহিনিসম্ভার। কোরআন আজিম কোনো কাব্যগ্রন্থ নয়; তবে এটি কাব্যরসে সিক্ত কালজয়ী মহাকাব্য। কোরআন করিম দুনিয়াবি কিতাব নয়; তবে দুনিয়ার সব বিষয়ের নির্দেশনা রয়েছে এতে।

ওহি বা প্রত্যাদেশ দ্বিবিধ, মাতলু ও গয়রে মাতলু। মাতলু অর্থ যা তিলাওয়াত বা আবৃত্তি করা হয়। গয়রে মাতলু অর্থ যা তিলাওয়াত করা হয় না। মূলত কোরআন হলো ওহি মাতলু এবং হাদিস হলো ওহি গয়রে মাতলু। কোরআন নামাজে পাঠ করা হয়, এ জন্য এটি মাতলু নামে অভিহিত। হাদিস সাধারণ নামাজে পাঠ করা হয় না, তাই এটি গয়রে মাতলু হিসেবে পরিচিত। তবে উভয়ই আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ। পার্থক্য হলো কোরআনের ভাব ও ভাষা উভয়ই আল্লাহর তরফ থেকে আসা আর হাদিসের ভাব আল্লাহর তরফ থেকে হলেও ভাষা নবীজি (সা.)-এর মুখ থেকে নিঃসৃত। কোনো হাদিস আল্লাহর ভাব ও বর্ণনায় বিবৃত হলে তা ‘হাদিসে কুদসি’ নামে পরিচিত।

ভাষা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। গড়ে প্রতি ১২ মাইল বা ২০ কিলোমিটার অন্তর ভাষার ধ্বনি বা উচ্চারণে তারতম্য সৃষ্টি হয়। সেহেতু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মুখনিঃসৃত বাণীও ভাব বজায় রেখে পরিবর্তিতরূপে বর্ণনা করা যায়। যাকে ‘রিওয়াইয়াত বিল মাআনা, তথা ভাব বর্ণনা এবং ‘রিওয়াইয়াত বিল হুকুম’ অর্থাৎ বিধান বর্ণনা বলা হয়।

সর্বশেষ আসমানি কিতাব আল কোরআন, যার হেফাজত বা সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জিম্মাদারিতে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘নিশ্চয়ই আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং অবশ্যই আমিই তা সংরক্ষণ করব।’ (সুরা-১৫ [৫৪] হিজর, আয়াত: ৯)। ‘নিশ্চয় সে কোরআন সংরক্ষিত লিপিতে রয়েছে; তা পবিত্রগণ ব্যতীত কেউ স্পর্শও করতে পারে না। যা বিশ্ব প্রভুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’ (সুরা-৫৬ [৪৬] ওয়াকিআহ, আয়াত: ৭৭-৮০)। যা অবতারিত হয়ে রুহুল আমিনখ্যাত সবচেয়ে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী ফেরেশতা হজরত জিবরাইল আমিন (আ.)-এর মাধ্যমে। ‘বরং তা সম্মানিত কোরআন; আছে সংরক্ষিত পটে।’ (সুরা-৮৫ [২৭] বুরুজ, আয়াত: ২১-২২)।

দুনিয়াতে কোরআন এসেছে আল আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপরে। তদুপরি আল্লাহ পাক বলেছেন: ‘(হে রাসুল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি দ্রুত আত্মস্থ করার জন্য জবান নাড়াতে হবে না। নিশ্চয় আমারই জিম্মায় তা একত্র করা ও পাঠ করানোও। আর যখন আমি তা পাঠ করাই, তখন আপনি তার অনুসরণ করুন।’ (সুরা-৭৫ [৩১] কিয়ামাহ, আয়াত: ১৬-১৯)। এতৎসত্ত্বেও কোরআন করিম অন্তত সাতভাবে পড়ার বৈধ অনুমোদন দিয়েছেন শরিয়ত প্রবক্তা হজরত (সা.), যার প্রতিটিই বিশুদ্ধ। তিনি বলেন: ‘নিশ্চয় এই কোরআন সাত বর্ণে অবতীর্ণ; সুতরাং তোমরা পড়ো তার যেটি তোমার সহজ হয়।’ (আবু দাউদ শরিফ) কোরআন শরিফের এই কিরাতের বা পাঠের ভিন্নতায় অর্থে যেমন বৈচিত্র্য আসে; তেমনি ভাবেও আসে সমৃদ্ধি এবং তাফছিরে উন্মোচিত হয় নতুন নতুন দিগন্ত; বিধানে আসে সাবলীলতা।

কোরআন কী? লেখা, উচ্চারণ নাকি অর্থ? লেখা, উচ্চারণ ও অর্থ এই তিনের সম্মিলিত নাম কোরআন। কোরআন পাকের হক অধিকার বা কর্তব্য ৪টি। যথা: ১. ইমান বা বিশ্বাস করা যে কোরআন আল্লাহ তাআলার সর্বশেষ কিতাব, যা হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, এতে অনুসরণকারীগণের জন্য হিদায়াত তথা দুনিয়ার শান্তি পরকালের মুক্তির পথনির্দেশ নিহিত রয়েছে। ২. ছহিহভাবে তিলাওয়াত করা। ৩. সঠিকভাবে অর্থ বোঝা। ৪. পরিপূর্ণরূপে আমল করা।

তিনটি বস্তু দেখলে ছাওয়াব হয়: ১. কোরআন শরিফ। ২. কাবা শরিফ। ৩. পিতা-মাতার চেহারা মোবারক। কোরআন শরিফ তিলাওয়াতে ফরজ ৩টি: ১. হরফগুলো সঠিকভাবে উচ্চারণ করা। ২. হারকাত তাড়াতাড়ি পড়া। ৩. মাদ হলে টেনে পড়া। কোরআন শরিফ পড়তে তিনটি কাজ করতে হয়: ১. পবিত্র হওয়া (ফরজ)। ২. আউজু বিল্লাহ পড়া (ওয়াজিব)। ৩. বিসমিল্লাহ পড়া (সুন্নত)। তিনটি কাজে পবিত্রতা প্রয়োজন (ফরজ) হয়: ১. নামাজ পড়া। ২. কাবা শরিফ তাওয়াফ করা। ৩. কোরআন শরিফ স্পর্শ করা। তিন প্রকার লোকের ভুল মাফ হয়: ১. যাঁরা সহিহ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন, ২. যাঁরা সহিহ করার চেষ্টায় রত আছেন, ৩. যাঁদের সহিহ শিক্ষার সুযোগ নেই বা সহিহ ও ভুলের জ্ঞান নেই।

অনেকে মনে করেন, ‘কিরাত’ মানে সুর করে পড়া, আর দ্রুত পড়লে তেমন কোনো নিয়ম পালন করতে হয় না; আসলে এ ধারণাটিও সঠিক নয়। মূলত কোরআন শরিফ তিনভাবে পড়া যায়—হদর, তাদবির ও তারতিল। ‘হদর’ হলো দ্রুত পড়া (যেমন হাফেজ সাহেবগণ তারাবির নামাজে পড়েন), ‘তাদবির’ হলো মধ্যম পড়া (যেমন আলেমগণ সাধারণ ফরজ নামাজে পড়েন) আর ‘তারতিল’ হলো ধীরে পড়া (যেমন কারি সাহেবগণ পড়ে থাকেন)। হদর পড়ার সময় মাদ্দে ফারয়িগুলো ও গুন্নাহসমূহ কছর বা কমানো যায়। কিন্তু সব অবস্থায় আরবি ব্যাকরণের তিনটি ‘ফরজ’ সূত্র অবশ্যপালনীয়। তা হলো: ক. হরফগুলো সঠিকভাবে উচ্চারণ করা, খ. হারকাত তাড়াতাড়ি পড়া, গ. মাদ হলে টেনে পড়া। কোনো অবস্থাতেই এর ব্যতিক্রম করার সুযোগ নেই। কারণ বিধান হলো: নামাজের বাইরে কোরআন তিলাওয়াত করা ‘নফল’ ঐচ্ছিক বা অতিরিক্ত ইবাদত আর বিশুদ্ধ উচ্চারণে কোরআন তিলাওয়াত করা ‘ফরজ’ (অবশ্যকরণীয় অলঙ্ঘনীয় কর্তব্য); সুতরাং নফলের জন্য ফরজ, ওয়াজিব তরক করা জায়েজ (বৈধ) হবে না। (ফাতাওয়ায়ে শামি)

‘তারতিল’ শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, ‘তারতিল’ মানে শুদ্ধ পাঠ (যখন শব্দটি স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহৃত হয়); এ অর্থে সকল প্রকার শুদ্ধ পাঠই তারতিল (এ তারতিল ফরজ)। দ্বিতীয়ত, তারতিল শব্দটি যদি ‘হদর’ ও ‘তাদবির’-এর পাশাপাশি ব্যবহার হয়, তখন এর অর্থ হবে ধীরে পড়া বা সুন্দর করে পড়া (এ তারতিল নফল)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

smusmangonee@gmail.com