ধর্ম

মানবের চালিকা শক্তি কলব

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

কলব সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে বহু আয়াত রয়েছে, যেসব আয়াতে কলবের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন ‘তাদের কলবগুলোতে রোগ আছে।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ১০)। ‘তাদের কলব আছে, কিন্তু তারা তদ্দ্বারা বোঝে না।’ (সুরা: আরাফ, আয়াত: ১৭৯)। ‘তবে যদি তাদের কলব থাকত, যা দ্বারা তারা বিবেচনা করবে।’ (সুরা: হজ, আয়াত: ৪৬)।
হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা (মুদগা) আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরাটি হলো কলব।’ বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৯-৪০, হাদিস: ৫০)।
হারাম ও সন্দেহজনক কার্যাবলি থেকে বাঁচতে চাইলে প্রথম স্বীয় আকল বা বিবেককে ঠিক করতে হবে। কারণ, মানুষের বিবেকই মানবদেহরূপী কারখানার জন্য চালক যন্ত্রস্বরূপ। মানবের কর্তব্য, তার বিবেক-বুদ্ধিকে ঠিক রেখে তারপর সেই সুষ্ঠু জ্ঞান-বিবেকের দ্বারা স্বীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পরিচালিত করা।
এই হাদিস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব ও দেহতত্ত্বের ইঙ্গিতদানে মানবের প্রকৃত উন্নতির উপায় নির্দেশ করা হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে যে স্থূল দেহের উন্নতি অপেক্ষা আত্মার (বিবেকের) উন্নতির ওপরই মানুষের প্রকৃত ও মূল উন্নতি নির্ভর করে। আত্মার বা বিবেকের উন্নতি সাধিত না হলে মানবজীবন বিফল ও অত্যন্ত বিড়ম্বনায় পতিত হয়।
এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘মুদগা’ বলে মানবদেহের যে বিশিষ্ট অংশটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন, সে অংশটি হচ্ছে আকল বা বিবেক। এর উন্নতিতে পূর্ণ মানবদেহের উন্নতি এবং এর অবনতিতে সম্পূর্ণ মানবদেহের অবনতি ঘটে থাকে। অর্থাৎ বিবেক রত্নটির উন্নতি সাধিত হলে সমগ্র মানবদেহের উন্নতি হবে এবং তার অবনতিতে সমগ্র মানবদেহেরই অবনতি ঘটবে।
এখন দেখতে হবে যে ওই অংশটির উন্নতির অর্থ কী। বস্তুত প্রতিটি জিনিসের উন্নতি বা অবনতি বিচার করা হয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালনের ওপর। তাই এখানে দেখতে হবে যে বিবেকের ওপর কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। কারণ, বিবেক বলে যার নামকরণ করা হয়েছিল, তার কর্তব্য ছিল সদাচার, সততা, সত্যতা ও আল্লাহর বশবর্তিতা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নফসের মধ্যে যে অপশক্তি আছে, তাদের বশে এনে ফেরেশতার সৎ গুণাবলিতে পরিচালিত করা। অতএব, বিবেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তা-ই হবে। এই মহান কর্তব্য পালনে বিবেক যতটুকু উন্নতি করতে পারবে, পূর্ণ মানবদেহটি ততটুকুই উন্নতি লাভ করবে। পক্ষান্তরে বিবেক নিজের ওই কর্তব্যে ত্রুটি করে নিজেই যদি প্রবৃত্তির বশ্যতা স্বীকার করার অবনতিতে পতিত হয়, তাহলে পূর্ণ মানবদেহই অবনতির অন্ধকার গর্তে পতিত হবে।

আধ্যাত্মিক জ্ঞানবিশারদেরা বিবেকের উন্নতির পাঁচটি স্তর বর্ণনা করেছেন: (১) আল্লাহকে স্মরণ করা, আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে জিকির করা, (২) আল্লাহর মহৎ গুণাবলির ধ্যান করা এবং ওই ধ্যানের দ্বারা নিজের মধ্যে ওই গুণের প্রতিবিম্ব হাসিল করা, (৩) আল্লাহর গুণাবলির তত্ত্বজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করা, (৪) আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণত হওয়া এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মানো এবং সেগুলো ফানা ও বিলুপ্ত করে দেওয়া। অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণরূপে দখল ও অধিকার করার সামর্থ্য অর্জন করা, (৫) আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া, যাকে আল্লাহর খেলাফত লাভ বলে। এ অবস্থাতেই বিবেক ও আকলের পূর্ণ শুদ্ধি হয়ে যায়। এই অবস্থার পর আর বিবেক ও আকলকে কুপ্রবৃত্তির বশীভূত হতে হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানবের স্বীয় আকল ও বিবেককে সঠিক করার যে প্রেরণা দান করেছেন, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবাত্মার চরম ও পরম উন্নতির উচ্চপর্যায়। (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৭১-৭৪, হাদিস: ৪৭, আল্লামা আজীজুল হক)।

বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ তাফসিরে মাজহারিতে কাজি সানাউল্লাহ পানিপথি রহমতুল্লাহি আলাইহি কলবের ব্যাখ্যা লিখেছেন: ‘কলব এমন একটি বিষয়, যা বোধ ও জ্ঞান অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর “কলব”-এর রোগ হলো মূর্খতা, হিংসা, কুফর ও মন্দ ধারণা বা বদ আকিদাহ (ভুল বিশ্বাস)।’ (তাফসিরে মাজহারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৩ ও ২৬)। প্রখ্যাত তাফসিরকারক আল্লামা মাহমুদ আলুছি বাগদাদি রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ রুহুল মাআনিতে কলবের ব্যাখ্যা লিখেছেন: ‘আর কলব বলা হয় আল্লাহ প্রদত্ত আলোকিত জ্ঞানী সত্তাকে, যা আল্লাহর নুর অবতরণের স্থল, মানুষের কারণেই মানুষ পদবাচ্য হয়, এর দ্বারাই মানুষ নির্দেশ পালন ও নিষেধ বর্জনে সক্ষম হয়। বহু মুহাক্কিকিন মত দিয়েছেন যে এই কলবই হলো জ্ঞানের উত্স, বলা হয়েছে নিশ্চয় তা হলো মস্তিষ্কে; আর তা হলো ইমানের কেন্দ্রস্থল।’ (রুহুল মাআনি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২০ ও ২২১)। সুবিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ তাফসিরে রুহুল বায়ান-এ শাঈখ ইসমাইল হাক্কি রহমতুল্লাহি আলাইহি কলবের ব্যাখ্যা লিখেছেন, ‘কলব হলো জ্ঞানশক্তির কেন্দ্রস্থল, যাকে বিবেক বলা হয়, আর “কলব” দ্বারা বোধ ও বিবেক উদ্দেশ্য হয়, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “নিশ্চয় এর মধ্যে তাদের জন্য উপদেশ রয়েছে, যাদের ‘কলব’ আছে (অর্থাৎ ‘আকল’ আছে)।”(তাফসিরে রুহুল বয়ান, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৪৮)।

প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক আবুল হাছান আলি আল মাওয়ারিদি রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ আদাবুদ দীন ওয়াদ দুনিয়ায় ‘আকল ও হাওয়া (জ্ঞান ও রিপু)’ অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত এভাবে তুলে ধরছেন, ‘আকল হলো, যা আল্লাহ
দীনের মূল ও দুনিয়ার ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করেছেন।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘মানুষ যা অর্জন করেছে, এর মধ্যে আকলের তুল্য আর কিছুই নেই, আকলই মানুষকে সঠিক পথ নির্দেশ করে এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে আরও বর্ণিত আছে, ‘মানুষের আকল অনুপাতে তার রবের ইবাদত সম্পাদিত হয়ে থাকে।’ হজরত উমার ইবনে খত্তাব (রা.) বলেছেন, ‘মানুষের মূল সম্পদ হলো তার আকল ও বিচার-বুদ্ধি।’ হজরত হাসান বসরি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলছেন, ‘আল্লাহ যাকে আকল দান করেছেন, কখনো না কখনো সে তা প্রয়োগ করতে পারে।’

নিশ্চয় আকল দ্বারাই সবকিছুর প্রকৃত রূপ অনুধাবন করা যায় এবং ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। আকলের সঙ্গেই দায়িত্ব-বিধান সম্পর্কিত, এর দ্বারাই মানুষ ও সব প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হয়। সলিহ ইবনে আবদুল কুদ্দুছ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘যখন মানুষের আকলের পূর্ণতা লাভ হয়, তখন তার সকল কিছুই পূর্ণ হয়।’ বিশেষজ্ঞরা আকল প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তা হলো এক সূক্ষ্ম বস্তু, যা দ্বারা তথ্যের প্রকৃত স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করা যায়। এর স্থান হলো মস্তিষ্ক।’

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

smusmangonee@gmail.com