শিল্পী যামিনী রায়ের আঁকা মনসা দেবীর প্রতিকৃতি
শিল্পী যামিনী রায়ের আঁকা মনসা দেবীর প্রতিকৃতি

মনসা: বাংলার লোকপ্রকৃতির দেবী

বাংলা সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষায় পড়তে যান বা চাকরির বাজারের জন্য যত সংক্ষেপেই পড়ুন, দেবী মনসার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হবেই। বাংলা ভাষার মধ্যযুগীয় সাহিত্যের দৃষ্টান্তে, মঙ্গলকাব্যের পাতায়, লোকজ সংস্কৃতি ও বর্তমান অর্থনীতিতে এই দেবী–সংক্রান্ত বিশ্বাস এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তা নিয়ে কিছু জানলে লাভ বৈ ক্ষতি নেই। ১৭ জুলাই হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী মনসা দেবীর পক্ষ।

সনাতন ধর্মে যে বিশেষ একত্ববাদ আছে, তার মূল কথাটি হলো এক সত্তাই বহু, বহু সত্তাই এক। ভাষার যেমন মূল সত্তা ধ্বনি, আবার সেই ধ্বনির রূপ দুটি—স্বর ও ব্যঞ্জন, তেমনি নিরাকার ব্রহ্মকে যখন সাকার হিসেবে কল্পনা করা হয়, তাঁরও দুটি রূপ—প্রকৃতি ও পুরুষ। সেই প্রকৃতিকে আদ্যাশক্তি মহামায়াও বলা হয়, যাঁর আবার অনন্ত রূপ। তাঁর মধ্যে আমাদের এ বাংলা অঞ্চলে এক বিশেষ পূজিত রূপ হলেন দেবী মনসা।

আমাদের বাংলা অঞ্চলে জলাভূমি বেশি। নদী, খাল–বিল ছিল আগেকার দিনে ব্যবসা, বাণিজ্য, নিত্যদিনের অপরিহার্য কাজের একটা অংশ। সেই সঙ্গে ছিল জংলাভূমিও। এই জল-জঙ্গলের বিপদ যা ছিল; বিষধর সাপ, কী হিংস্র কুমির, শ্বাপদ ব্যাঘ্র—এরা কখনো মালা হয়ে ঝুলেছেন দেবতা শিবের গলায় কিংবা কখনো হয়েছেন সুফি–দরবেশদের পোষ্য বা দেব–দেবীর বাহন।

প্রকৃতিকে আদ্যাশক্তি মহামায়াও বলা হয়, যাঁর আবার অনন্ত রূপ। তাঁর মধ্যে আমাদের এ বাংলা অঞ্চলে এক বিশেষ পূজিত রূপ হলেন দেবী মনসা।

হিন্দুশাস্ত্র মতেও, এ সর্পবিঘ্ন থেকে প্রাণিজগতের রক্ষার্থে যিনি কাশ্যপ মুনির চিন্তাশক্তি থেকে, ওই যে শুরুতে লিখলাম আদ্যাশক্তি, তিনি যে রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনিই মনসা দেবী—সিদ্ধিদায়িনী, মহাজ্ঞানযুক্তা। দেবী ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেবীর মাহাত্ম্য, মন্ত্র, ধ্যান ও পূজাবিধি বিস্তারে বর্ণিত আছে। এটি বলার কারণ হলো অনেকেই মনসাকে কেবল লোকদেবী বলে তকমা দিতে চান। বস্তুত লোককাহিনিতে দেবী উপাখ্যানগুলো ডালপালা মেলেছেই কেবল, শিকড় আর্যশাস্ত্রের গহিনেই প্রোথিত।

বাংলা সাহিত্যে মনসা দেবী একাধিক মঙ্গলকাব্যের প্রধান উপজীব্য। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ বিজয় গুপ্তদের রচিত ‘চাঁদ সওদাগর ও বেহুলা-লখিন্দর’-এর কাহিনি। এর ওপর ভিত্তি করে কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানসহ অনেকেই দুই বাংলাতেই একাধিক চলচ্চিত্র, নাটিকা, টিভি নাটক নির্মাণ করেছেন। হয়েছে ‘শূন্য’ ব্যান্ডের শ্রুতিমধুর জনপ্রিয় বাংলা গানও।

প্রাচীন এই কথামালার এখনো এ প্রাসঙ্গিকতার কারণ দেবী মনসার উপাখ্যান কেবল ধর্মীয় নীতিকথা নয়; বরং নারীর সাহস, ভালোবাসা, সামাজিক অনিয়ম ও ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে নব বিধানের এক শক্তিশালী প্রতিবাদচিত্র।

মনসা দেবীর পূজায় পশুবলি ও বলির মাংস পুরো গ্রামবাসী মিলে খাওয়ার আচারও পুরাণসম্মত। দেবী ভাগবতে, যেমন দেবরাজ ইন্দ্র ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের আদেশে বলিসহ ষোড়শোপচারে মনসা দেবীর পূজা করেন, তেমনই ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও বলা হয়েছে। তাই বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ সময় বিশাল ছাগল বা পাঁঠার হাট বসে।

মনসা দেবীর পূজায় পশুবলি ও বলির মাংস পুরো গ্রামবাসী মিলে খাওয়ার আচারও পুরাণসম্মত।

এখানে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের ভাগ্য ফিরেছে ছাগলের ব্যবসা করে। ছাগল কিনে এনে এক বাড়ির ছাগলের সঙ্গে আরেক বাড়ির ছাগলের লড়াইও চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্রামগুলোর অন্যতম ঐতিহ্য। অনেক গ্রামে এ লড়াইকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন করা হয়। আর পূজার দিন বলি শেষে পুরো গ্রামের বা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে হয় ভোজ। চট্টলার হাটহাজারী উপজেলার মেখল গ্রামে রাজু রায়ের বাড়ির মনসাপূজার ভোজ এ রকমই বিখ্যাত ছিল।

তবে যুগের সঙ্গে মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটায় এখন অনেক জায়গায় পাঁঠাছাগলের পরিবর্তে কলা, লাউ, আখ, কাঁঠাল ইত্যাদি ফল বা সবজি দিয়ে প্রতীকী বলি দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের মাটির ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে মনসা দেবীর নানা সংস্কৃতি। প্রাচীন নগরী মহাস্থানগড়েও একটি টিলা আছে, যেটিকে বেহুলা–লখিন্দরের লোহার বাসরঘর বলে স্থানীয়ভাবে বিশ্বাস করা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছে বহু প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মনসামন্দির, যেগুলো স্থানীয় লোকবিশ্বাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।

মনসা দেবী কেবল নাগদেবী নন, তিনিই যোগশাস্ত্রে উল্লিখিত দেহের মধ্যকার কুলকুণ্ডলিনীর চেতনা, ব্রহ্মজ্ঞানস্বরূপা।

যেমন বরিশালের আগৈলঝাড়ার শতাব্দীপ্রাচীন মনসামন্দির, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কুসুমপুরা মনসামন্দির, নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় অবস্থিত রামচন্দ্রপুর মনসামন্দির—আরও কত! এগুলো ভৌগোলিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে অবস্থিত হলেও দেবীর নামে একই সুতোয় বাঁধা। প্রতিবছর বার্ষিক পূজার পক্ষগুলোতে এসব অঞ্চল মুখর হয় বাইশ কবির পাঁচালিতে বা বিজয় গুপ্তের লেখনীর সুরেলা পদাবলিতে।

মনসা দেবী কেবল নাগদেবী নন, তিনিই যোগশাস্ত্রে উল্লিখিত দেহের মধ্যকার কুলকুণ্ডলিনীর চেতনা, ব্রহ্মজ্ঞানস্বরূপা। তাঁর বাহন রাজহংস তাই প্রতীক হয়ে ওঠে ভেদজ্ঞান ও বিশুদ্ধ চেতনার। আজ যখন দেবীর আরাধনা করি, তখন হয়তো দরকার তাঁর সেই গভীরতর রূপটিকে খুঁজে পাওয়ার, যেখানে বাহ্যিক আচারের চেয়ে অন্তরের অর্ঘ্য বড় হয়ে ওঠে। পরিস্ফুটিত হয় এই বাংলার মাটির ভাষা, জনমানুষের আকুতি।

সায়ন্তন সৈকত রায়: লেখক, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র সমালোচক