কোরআনের কথা

গুহার ভেতর ৩০৯ বছরের এক ঘুম

পবিত্র কোরআনের ১৮তম সুরা কাহাফ মক্কায় অবতীর্ণ, যার আয়াত সংখ্যা ১১০। এই সুরায় ‘আসহাবে কাহাফ ওয়ার রাকিম’ নামে পরিচিত সাত যুবকের গল্প বর্ণিত হয়েছে। ‘কাহাফ’ অর্থ গুহা, আর ‘রাকিম’ অর্থ পর্বতের নাম বা ফলক। সুরার ৯ থেকে ২৬ নম্বর আয়াতে এই যুবকদের ইমান গ্রহণ, ইমান রক্ষায় শহর ত্যাগ এবং গুহায় আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যুবকেরা গুহায় আশ্রয় নিয়ে বলল, হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি তোমার কাছ থেকে আমাদের রহমত দান করো এবং আমাদের ব্যাপারটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করো। অতঃপর আমি তাদের গুহায় ঘুমন্ত অবস্থায় কয়েক বছর রেখে দিলাম।’ (সুরা কাহাফ, আয়াত: ১০-১১)

এ ঘটনার সময়কাল সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ কেউ মনে করেন, এটি হজরত ঈসা (আ.)-এর সময়ের কিছু পরে ঘটেছিল। এটি আনবাত (নাবত) সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঐতিহাসিক সূত্র, তাওরাতের ভাষ্য এবং রোমান ও গ্রিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, নাবতিরা খাঁটি আরব এবং ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর। ইসমাইল (আ.)-এর ১২ জন পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন নাবিত বা নাবত। (কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ: আব্দুস সাত্তার আইনী, ৯/১৩-১৪)

ঘুম ভাঙার পর যুবকেরা জানতে চাইলেন, তাঁরা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলেন। একজন বললেন, ‘এক দিন’, আরেকজন বললেন, ‘এক দিনের কিছু অংশ।’ খাবার কিনতে একজনকে মুদ্রা দিয়ে শহরে পাঠানো হলো।

ঘটনার সময় খ্রিষ্টধর্মের প্রাথমিক যুগ। নাবতিদের শাসনাধীন শাম ও অন্যান্য অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্মের প্রভাব ছিল। কিন্তু রাকিম (বর্তমান পেত্রা) নগরীর সবাই ছিল মুশরিক, এমনকি বাদশাহও ছিলেন মূর্তিপূজক। সাত যুবক মূর্তিপূজা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা পৃথিবীর সৃষ্টি, আকাশের সৌন্দর্য, বাতাসের গতি, জীবন-মরণের রহস্য পর্যবেক্ষণ করে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার সন্ধান করছিলেন। অবশেষে তাঁদের হৃদয় তাওহিদের আলোয় উদ্ভাসিত হলো এবং তাঁরা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেন।

এই খবর বাদশাহর কাছে পৌঁছালে তিনি যুবকদের ডেকে পাঠান। যুবকেরা নির্ভয়ে আল্লাহর বাণী প্রচার করেন। বাদশাহ এটি অপছন্দ করলেও তাঁদের পুনর্বিবেচনার জন্য কিছু সময় দেন। কিন্তু যুবকেরা সিদ্ধান্ত নেন পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করার। (কাসাসুল কোরআন, ৯/২২)

বাদশাহ তাঁদের হত্যার নির্দেশ দিলে তাঁরা ইমান রক্ষায় গুহায় আশ্রয় নেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল কিতমির নামের একটি কুকুর, যা গুহার মুখে পাহারায় বসে। বাদশাহর বাহিনী তাঁদের খুঁজে পায়নি।

গুহাটি ছিল প্রশস্ত, জীবন রক্ষার প্রাকৃতিক উপকরণে সমৃদ্ধ। একদিকে ছিল গুহার মুখ, অন্যদিকে বায়ু চলাচলের পথ, যার মাধ্যমে সতেজ বাতাস প্রবাহিত হতো। গুহাটি উত্তর-দক্ষিণে অবস্থিত ছিল, ফলে সূর্যের তীব্র আলো ভেতরে প্রবেশ করতে পারত না, তবে মৃদু আলো সব সময় উপস্থিত থাকত। (কাসাসুল কোরআন, ৯/২২-২৩)

আল্লাহ আসহাবে কাহাফকে গুহায় ঘুম পাড়িয়ে দেন, যা ৩০৯ বছর ধরে চলেছিল। এ সময়ে শহরে বিপ্লব ঘটে, অত্যাচারী বাদশাহর মৃত্যু হয় এবং রোমান খ্রিষ্টানরা নাবতিদের পরাজিত করে রাকিম (পেত্রা) দখল করে।

তাঁদের সঙ্গে ছিল কিতমির নামের একটি কুকুর, যা গুহার মুখে পাহারায় বসে। বাদশাহর বাহিনী তাঁদের খুঁজে পায়নি।

ঘুম ভাঙার পর যুবকেরা জানতে চাইলেন, তাঁরা কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলেন। একজন বললেন, ‘এক দিন’, আরেকজন বললেন, ‘এক দিনের কিছু অংশ।’ খাবার কিনতে একজনকে মুদ্রা দিয়ে শহরে পাঠানো হলো। শহরে গিয়ে তিনি দেখলেন, সবকিছু বদলে গেছে—নতুন মানুষ, নতুন সংস্কৃতি। ভয়ে তিনি একটি দোকান থেকে খাবার ও পানি কিনলেন। দোকানি দেখলেন, মুদ্রাটি প্রাচীন। ঘটনা জানাজানি হলে শহরবাসী যুবককে অভ্যর্থনা জানান। খ্রিষ্টধর্মের বিস্তার দেখে তিনি আনন্দিত হন। গুহায় ফিরে তিনি সঙ্গীদের বিস্তারিত জানান। এদিকে বর্তমান বাদশাহ খবর পেয়ে গুহায় গিয়ে দেখেন, সবাই মারা গেছেন। তিনি গুহার মুখে তাঁদের স্মরণে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। (সুরা কাহাফ, আয়াত: ১৯-২৩)

গুহার অবস্থান সম্পর্কে কোরআনে স্পষ্ট বর্ণনা নেই। ইবনে আতিয়ার মতে, এটি সিরিয়ায়, অন্য মতে স্পেনের গ্রানাডায়। ইমাম কুরতুবি ও অধিকাংশ তাফসিরকারক মনে করেন, এটি তরসুস (এশিয়ার পশ্চিম উপকূলে) অবস্থিত। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, গুহাটি জর্ডানের আয়লা (আকাবা উপসাগরের কাছে) অবস্থিত (তাফসিরে তাবারি, ১৭/৬০২) গবেষকেরা জর্ডানের অবস্থানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, নাবতিদের শাসন খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ সালে শুরু হয়ে ১০৬ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয়। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমানরা নাবতিদের পরাজিত করে রাকিম দখল করে এবং এর নাম পরিবর্তন করে পেত্রা রাখে। এই পেত্রাই কোরআনে উল্লিখিত রাকিম, যেখানে আসহাবে কাহাফের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। (কাসাসুল কোরআন, ৯/১৯)

লেখক: আলেম