মাহমাল: কিসওয়া পরিবহনের পালকি
মাহমাল: কিসওয়া পরিবহনের পালকি

মাহমাল:

কিসওয়া পরিবহনের পালকি

পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ, একসময় হজ কাফেলার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিবহন করা হতো। এই উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত রেশম কাপড়ে তৈরি গম্বুজ আকৃতির পালকিকে বলা হতো মাহমাল। মাহমাল কেবল গিলাফ (কিসওয়া) পরিবহনের মাধ্যমই ছিল না, বরং এটি খেলাফত বা সালতানাতের প্রশাসনিক প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হতো।

মাহমাল ছিল উন্নত মানের রেশম কাপড়ে তৈরি একটি পালকি, যার গায়ে স্বর্ণ ও রুপার প্রলেপ দেওয়া সুতা দিয়ে কোরআনের আয়াত এবং খলিফা বা সুলতানের নাম খোদিত থাকত। এর অভ্যন্তরে কিসওয়া ছাড়াও বিভিন্ন মূল্যবান উপহারসামগ্রী থাকত। মাহমাল মক্কার শরিফের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হতো। হজ কাফেলার সঙ্গে মাহমাল প্রেরণ ছিল প্রশাসনের মর্যাদা ও পবিত্রতার প্রতীক।

সৌদি আরব ও অন্যান্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে আরব উপদ্বীপ বিভিন্ন খেলাফত ও সালতানাতের অধীনে ছিল। তারা মক্কা ও মদিনার পবিত্র মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং হজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। খলিফা বা সুলতানের তত্ত্বাবধানে হজ কাফেলার সঙ্গে নতুন কিসওয়া মক্কায় পাঠানো হতো এবং পুরোনো কিসওয়া ফেরত আনা হতো। মাহমাল এই পরিবহন–প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

কায়রোর মধ্য দিয়ে যাওয়া মাহমাল: ১৭৯১ সালের চিত্র, ইংরেজ খোদাইকারী রিচার্ড ডাল্টন।

১২৫০ সালে আইয়ুবীয় রাজত্বের অবসানের পর মিসরে মামলুক সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ১২৫০-১৫১৭ সাল পর্যন্ত মিসর, সিরিয়া এবং হেজাজ অঞ্চলে প্রশাসন চালায়। ইতিহাসবিদদের মতে, মামলুক সুলতান আল-জহির বাইবার (১২৬০-১২৭৭) ১২৬৬ সালে মিসরীয় হজ কাফেলার সঙ্গে প্রথম মাহমাল প্রেরণ করেন। তবে কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, আইয়ুবীয় সুলতান আস-সালিহ আইয়ুবের স্ত্রী শাজারাত আল-দার প্রথম তাঁর নামাঙ্কিত মাহমাল হজের সময় মক্কায় নিয়ে যান। পরবর্তী বছর তিনি হজে না গেলেও তাঁর স্মৃতিস্বরূপ মাহমাল প্রেরণ করেন।

মাহমাল প্রেরণ পরবর্তীকালে একটি বার্ষিক উৎসবে পরিণত হয়। মিসরের কায়রোতে প্রশাসকের প্রাসাদ–সংলগ্ন স্কয়ারে মাহমাল প্রেরণ উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের আয়োজন করা হতো। এতে অংশ নিতেন গভর্নর, সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সশস্ত্র সেনাদল এবং সাধারণ মানুষ। উৎসব শুরু হতো সেনাদলের কামানের তোপধ্বনির মাধ্যমে।

তিন দিন ধরে কায়রোর প্রধান সড়কগুলোতে উটের পিঠে মাহমালের মিছিল বের হতো। এ উপলক্ষে শহরের ঘরবাড়ি ও সড়কগুলো সাজানো হতো। মিছিল শেষে মাহমাল কায়রোর প্রধান মসজিদে রাখা হতো এবং পরে সেনাদলের পাহারায় হজ কাফেলার সঙ্গে মক্কায় পাঠানো হতো। ফিরতি যাত্রায় পুরোনো কিসওয়া মাহমালে করে ফেরত আনা হতো। এই কিসওয়া ছোট ছোট টুকরায় বিভক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপহার দেওয়া হতো, যা ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা পবিত্র স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করতেন।

মাহমালের প্রচ্ছদ এবং ব্যানার, কায়রো, ১৮৬৭–৭৬

মিসর ছাড়াও ইয়েমেন, ইরাক, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হজের সময় মাহমাল প্রেরণ করা হতো। তবে কেবল মিসরীয় মাহমালের মাধ্যমেই পবিত্র কাবার কিসওয়া পরিবহন করা হতো। ১৩ শতকে ওসমানীয় সালতানাতের সময় সিরিয়া থেকেও মাহমাল প্রেরণ করা হতো।

মাহমাল ও কিসওয়া পরিবহনের এই ঐতিহ্য ১৯২৬ সালে শেষ হয়। আধুনিক পরিবহনব্যবস্থা এবং সৌদি আরবের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার কারণে মাহমালের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। তবে এই ঐতিহ্য ইসলামি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় রয়ে গেছে।

মাহমাল ছিল কিসওয়া পরিবহনের একটি পবিত্র ও জাঁকজমকপূর্ণ ঐতিহ্য। এটি কেবল কাবাঘরের গিলাফ পরিবহনের মাধ্যমই ছিল না, বরং খেলাফত ও সালতানাতের প্রশাসনিক মর্যাদা এবং ধর্মীয় ভক্তির প্রতীক ছিল। মাহমালের ইতিহাস মুসলিম বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐক্যের একটি অমূল্য সাক্ষ্য বহন করে।