দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে রাতের নিস্তব্ধতা যখন চরাচরকে গ্রাস করে, মুমিনের হৃদয়ে তখন এক অপার্থিব প্রশান্তি নেমে আসে। এই প্রশান্তির অন্যতম উৎস হলো ইশার নামাজ। মহান আল্লাহর সঙ্গে নিভৃতে কথোপকথনের এক অনন্য সুযোগ তৈরি করে দেয় এই নামাজ।
কিন্তু ইশার নামাজ আদায়ের সর্বোত্তম সময় কোনটি—প্রথম ওয়াক্ত নাকি রাতের শেষ প্রহর? এই প্রশ্নটি মুমিনদের মনে প্রায়ই উদিত হয়। আজ আমরা আলোচনা করব।
ইশার নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করার ফজিলত সম্পর্কে হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জামাতের সঙ্গে ইশার নামাজ আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত পর্যন্ত নফল নামাজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করল, সে যেন সারা রাত নামাজ আদায় করল।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৫৬)
জামাতে ইশার নামাজ পড়ার এই ফজিলত ওয়াক্তের শুরুতে হোক বা শেষে—সর্বদাই প্রযোজ্য
তবে নামাজের সময় নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় কিছুটা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়, যা উম্মতের জন্য রহমত স্বরূপ।
আমার উম্মতের জন্য যদি কষ্টসাধ্য মনে না হতো, তবে আমি তাদের ইশার নামাজ রাতের এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক রাত পর্যন্ত বিলম্ব করে আদায় করার নির্দেশ দিতাম।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৬৭
ইশার নামাজ কিছুটা বিলম্বে আদায় করার মাঝে একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক রহস্য ও ফজিলত নিহিত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বহু হাদিসে ইশাকে কিছুটা দেরিতে পড়ার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমার উম্মতের জন্য যদি কষ্টসাধ্য মনে না হতো, তবে আমি তাদের ইশার নামাজ রাতের এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক রাত পর্যন্ত বিলম্ব করে আদায় করার নির্দেশ দিতাম।” (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৬৭)
এই হাদিসটি থেকে প্রতীয়মান হয়, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ ও সওয়াবের বিচারে ইশার নামাজ বিলম্বে পড়া বেশি উত্তম। দিনের কাজ শেষ করে, সংসার ও সামাজিক ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যখন মানুষ গভীর রাতে স্রষ্টার সামনে দাঁড়ায়, তখন একাগ্রতা বা ‘খুশু-খুজু’ বেশি অর্জিত হয়।
কিন্তু উম্মতের কষ্ট হবে ভেবে রাসুলুল্লাহ (সা.) একে বাধ্যতামূলক করেননি। বরং নামাজের ওয়াক্তকে প্রশস্ত রাখা হয়েছে। (আতিয়্যাহ সাকার, ফাতাওয়া আল-আজহার, ৭/৪৩৩, আল-মাজমাউল ইসলামি, কায়রো, ১৯৯৯)
রাসুল (সা.) ইশার নামাজের সময় নির্ধারণে সর্বদা সাহাবিদের উপস্থিতির ওপর নজর রাখতেন। তিনি কখনো ইশা জলদি পড়তেন, আবার কখনো বিলম্ব করতেন।
জাবির (রা.) এ প্রসঙ্গে একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন, আল্লাহর রাসুল কখনো ইশার নামাজ জলদি পড়তেন, আবার কখনো বিলম্ব করতেন। যখন তিনি দেখতেন যে সাহাবিগণ দ্রুত সমবেত হয়েছেন, তখন তিনি জলদি নামাজ আদায় করতেন। আর যখন দেখতেন তারা আসতে দেরি করছেন, তখন তিনি নামাজ বিলম্ব করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬০)
সুতরাং, যদি কোনো সমাজ বা মহল্লার মানুষ মনে করে যে তারা এশার নামাজ কিছুটা দেরিতে পড়লে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে জামাতে শরিক হতে পারবে, তবে দেরি করা উত্তম। আর যদি জলদি পড়লে মানুষের উপস্থিতি বেশি হয়, তবে সেটিই সেই পরিস্থিতির জন্য শ্রেষ্ঠ।
তবে সর্বোত্তম সময়ের অনুসন্ধান কেবল সময়ের কাঁটায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা নির্ভর করে জামাত এবং ইবাদতের একাগ্রতার ওপর। যদি একাকী বিলম্ব করে পড়ার চেয়ে জামাতে প্রথম ওয়াক্তে পড়া সম্ভব হয়, তবে জামাতই অগ্রগণ্য।
ইশার নামাজ কখন শুরু হয় এবং কখন শেষ হয়, তা নিয়ে ফকিহগণের মাঝে সূক্ষ্ম কিছু আলোচনা থাকলেও মূল সময়টি হাদিস দ্বারা সুস্পষ্ট। সূর্যাস্তের পর আকাশের পশ্চিম দিগন্তে যে লাল আভা (শাফাক) থাকে, তা অদৃশ্য হওয়ার পর থেকেই ইশার ওয়াক্ত শুরু হয়। আর এই সময়টি ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত স্থায়ী থাকে।
তবে সময়ের এই দীর্ঘ ব্যাপ্তিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়:
১. পছন্দনীয় সময়: রাতের এক-তৃতীয়াংশ বা মধ্যরাত পর্যন্ত। এটিই নামাজ আদায়ের সর্বোত্তম সময়।
২. অনুমোদিত সময়: মধ্যরাত থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত। ওজর বা বিশেষ প্রয়োজনে এই সময়ে নামাজ আদায় করলে তা আদায় হয়ে যাবে, তবে বিনা কারণে এত দেরি করা অনুচিত।
রাসুল (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই। ত্রুটি তো তার, যে ব্যক্তি নামাজের সময় হয়ে গেলেও নামাজ আদায় করেনি।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৮১)
এই হাদিসটি নির্দেশ করে যে, একটি নামাজের ওয়াক্ত অন্য নামাজের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বলবৎ থাকে। তবে মনে রাখতে হবে, ফজরের নামাজ এর ব্যতিক্রম। ফজরের ওয়াক্ত সূর্যোদয়ের সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়, জোহরের ওয়াক্ত পর্যন্ত গড়ায় না।
বর্তমানের যান্ত্রিক জীবনে আমাদের ঘুমের রুটিন ও কর্মব্যস্ততা অনেক বদলে গেছে। শহরের জীবনে এশা অনেক সময় এ কারণে আগে পড়া হয় যাতে মানুষ জলদি ঘুমাতে পারে এবং ফজরে সময়মতো উঠতে পারে। এটিও সুন্নাহর একটি অংশ। কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) ইশার আগে ঘুমানো এবং ইশার পর অপ্রয়োজনীয় গল্পগুজব করা অপছন্দ করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৬৮)
তবে সর্বোত্তম সময়ের অনুসন্ধান কেবল সময়ের কাঁটায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা নির্ভর করে জামাত এবং ইবাদতের একাগ্রতার ওপর। যদি একাকী বিলম্ব করে পড়ার চেয়ে জামাতে প্রথম ওয়াক্তে পড়া সম্ভব হয়, তবে জামাতই অগ্রগণ্য। কারণ জামাতে নামাজ আদায়ের ফজিলত অপরিসীম। অন্যদিকে, যদি কোনো বিশেষ মাহফিল বা ধর্মীয় আলোচনার কারণে নামাজ কিছুটা দেরি হয়, তবে তাতেও কোনো দোষ নেই।